বাংলাদেশের আইনে বাবার সম্পত্তি বন্টন নিয়ে অনেক নিয়ম-কানুন রয়েছে যা পারিবারিক সম্পত্তি কিভাবে ভাগ হবে তা নির্ধারণ করে। এই পোস্টে আমরা “বাবার সম্পত্তি বন্টন আইন বাংলাদেশ” সম্পর্কিত সকল বিষয়বস্তু আলোচনা করবো। সঠিক আইন জানা থাকলে সম্পত্তি বন্টন সহজেই সম্পন্ন করা সম্ভব।
বাবার সম্পত্তি বন্টনের মূল আইন
বাংলাদেশে বাবার সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়া আইন এবং সিভিল আইন উভয়ের প্রভাব রয়েছে। মুসলিম ব্যক্তির ক্ষেত্রে, বাবার সম্পত্তি শরিয়া আইনের অধীনে বন্টিত হয়। অন্য ধর্মের জন্য হিন্দু উত্তরাধিকার আইন এবং অন্যান্য ধর্মীয় আইন প্রযোজ্য।
ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী বাবার সম্পত্তি বন্টন আইন
ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী, বাবার সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বন্টন করা হয়। এ আইনের মূল ভিত্তি হলো কুরআন এবং হাদিস। শরিয়া অনুযায়ী সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, এবং অন্যান্য আত্মীয়দের নির্দিষ্ট ভাগ রয়েছে। নিচে এই আইনটির মূল বিষয়গুলো উল্লেখ করা হলো:
১. ছেলেদের অংশ
শরিয়া আইনে, ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে দ্বিগুণ অংশ পায়। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন বাবার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে থাকে, তবে ছেলেটি মেয়েটির চেয়ে দ্বিগুণ সম্পত্তি পাবে। কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “পুরুষের জন্য দুটি নারীর অংশের সমান।” (সুরা নিসা: ১১)
২. মেয়েদের অংশ
মেয়েরা পিতার সম্পত্তির অর্ধেক পায়, যা ছেলেদের তুলনায় কম। তবে তারা নিজেদের সম্পত্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পূর্ণ অধিকারভুক্ত। কুরআনের নির্দেশনা অনুসারে, মেয়েরা উত্তরাধিকার পেতে বাধ্য, এবং তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা শরিয়া মতে অন্যায়।
৩. স্ত্রীর অংশ
বাবার মৃত্যু হলে, স্ত্রী তার স্বামীর সম্পত্তির ১/৮ অংশ পায় যদি সন্তান থাকে, এবং ১/৪ অংশ পায় যদি সন্তান না থাকে। এই সম্পত্তি শুধুমাত্র স্বামীর সম্পত্তির উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়, এবং তিনি তার প্রাপ্য অংশের অধিকারভুক্ত।
৪. পিতামাতার অংশ
বাবার মৃত্যু হলে তার বাবা-মাও উত্তরাধিকারী হিসেবে অংশ পেতে পারেন। শরিয়া মতে, মৃত ব্যক্তির বাবা তার সন্তানের সম্পত্তির ১/৬ অংশ পাবে, এবং একইভাবে মা-ও ১/৬ অংশ পাবে।
৫. ভাই-বোনদের অংশ
যদি বাবার পুত্র বা কন্যা না থাকে, তাহলে ভাই-বোনরা উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পত্তির অংশ পেতে পারে। কুরআন অনুযায়ী, ভাই-বোনের অংশ নির্ধারিত হয় পুত্রসন্তান না থাকার ক্ষেত্রে।
৬. দায়িত্ব ও ঋণ পরিশোধ
মৃত ব্যক্তির ঋণ এবং অন্যান্য দায়িত্বগুলো তার সম্পত্তি থেকে বণ্টনের আগে পরিশোধ করতে হয়। শরিয়া আইনে এই দায়িত্বকে গুরুত্ব সহকারে পালন করা উচিত, কেননা এটি পবিত্র ধর্মীয় আদেশের অংশ।
উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয়:
- শরিয়া আইনের অধীনে, সম্পত্তির বণ্টন প্রক্রিয়া কুরআন এবং সুন্নাহ অনুযায়ী কঠোরভাবে পরিচালিত হয়।
- কেউ নিজে থেকে শরিয়া আইনের বাইরে গিয়ে অন্যভাবে সম্পত্তি ভাগ করতে পারে না।
- শরিয়া আইন বিশেষভাবে পুরুষ এবং নারীর জন্য পৃথক অংশ নির্ধারণ করে যা ধর্মীয় নির্দেশনা মেনে চলে।
এই নিয়মগুলো অনুসরণ করে ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী বাবার সম্পত্তি যথাযথভাবে বন্টিত হয়, যা পারিবারিক ঐক্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।
হিন্দু উত্তরাধিকার অনুযায়ী বাবার সম্পত্তি বন্টন আইন
বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী বাবার সম্পত্তি বন্টনের নিয়ম ইসলামী শরিয়া আইনের তুলনায় ভিন্ন। হিন্দু উত্তরাধিকার আইন প্রাথমিকভাবে ভারতীয় হিন্দু উত্তরাধিকার আইন থেকে প্রভাবিত, এবং এই আইনের অধীনে, পিতার সম্পত্তি ছেলে-মেয়ে ও অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বন্টন করা হয়। এখানে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের মূল দিকগুলো তুলে ধরা হলো:
১. কপার্থক (Coparcenary) সম্পত্তি
হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের অধীনে, বিশেষ করে হিন্দু যৌথ পরিবার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে, কপার্থক সম্পত্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। কপার্থক সম্পত্তি এমন সম্পত্তি, যা বাবার মৃত্যুর আগে থেকেই পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মধ্যে ভাগাভাগি হতে থাকে।
- শুধুমাত্র পুরুষ উত্তরাধিকারীরা (ছেলে, নাতি, প্রপৌত্র) এই সম্পত্তির ভাগ পায়।
- নারী সদস্যরা সাধারণত কপার্থক সম্পত্তির ভাগ পায় না, তবে অনেক আইন সংস্কারের মাধ্যমে মেয়েদেরও কিছু অধিকার দেওয়া হয়েছে।
২. স্বতন্ত্র (Self-acquired) সম্পত্তি
স্বতন্ত্র বা স্বম্যকৃত সম্পত্তি হলো এমন সম্পত্তি, যা ব্যক্তি নিজেই অর্জন করেছেন বা পেয়েছেন এবং এটি তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
- পিতা যদি তার জীবদ্দশায় স্বতন্ত্র সম্পত্তি রেখে যান, তবে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে ছেলে-মেয়েরা সমানভাবে সেই সম্পত্তির দাবিদার হবে।
- পিতার সম্পত্তি বন্টনের সময় ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হয়।
৩. মেয়েদের অংশ
২০০৫ সালের হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধনের মাধ্যমে, হিন্দু মেয়েরাও বাবার সম্পত্তিতে সমান অংশ পাওয়ার অধিকারী হয়েছে। এর ফলে, হিন্দু মেয়েরা কপার্থক সম্পত্তি এবং স্বতন্ত্র সম্পত্তির উভয়ের ক্ষেত্রেই সমান অধিকার পায়।
- মেয়েরা কপার্থক সম্পত্তির ক্ষেত্রে ঠিক ছেলেদের মতোই সমান অধিকারভুক্ত।
- এটি আইন সংস্কারের একটি বড় পদক্ষেপ, যা নারীর অধিকারকে সুরক্ষিত করেছে।
৪. ছেলেদের অংশ
আইন অনুযায়ী, হিন্দু পিতার ছেলেরা তার সম্পত্তির সমান অংশের অধিকারী হয়। আগে ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে বেশি অধিকার পেত, তবে ২০০৫ সালের সংশোধনী আইন অনুসারে ছেলে-মেয়েদের সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে।
৫. বাবার মৃত্যুতে স্ত্রী ও মা
বাবার মৃত্যুর পরে, তার স্ত্রীও তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন।
- বাবার স্ত্রী তার স্বামীর সম্পত্তির একাংশের অধিকারী হন।
- পিতার জীবিত মা থাকলে তিনিও উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পত্তি দাবি করতে পারেন।
৬. উইল (ইচ্ছাপত্র) থাকলে সম্পত্তি বন্টন
হিন্দু আইন অনুযায়ী, যদি পিতা মৃত্যুর আগে তার সম্পত্তির বিষয়ে কোনো উইল বা ইচ্ছাপত্র তৈরি করে যান, তবে সেই উইল অনুযায়ী সম্পত্তি বণ্টন হবে।
- উইল না থাকলে স্বাভাবিক উত্তরাধিকার আইনের ভিত্তিতে সম্পত্তি ভাগ হয়।
- যদি উইলে কোনো বিশেষ নির্দেশনা থাকে, তবে সেটির অনুসরণ বাধ্যতামূলক।
৭. যৌথ পরিবার ব্যবস্থার বন্টন
হিন্দু যৌথ পরিবার ব্যবস্থায়, পরিবারের সকল পুরুষ সদস্যদের যৌথভাবে সম্পত্তি ভোগদখলের অধিকার থাকে। তবে, তারা চাইলে পারিবারিক সম্পত্তি ভাগাভাগি করে নিতে পারে। যৌথ পরিবার ভেঙে গেলে, সম্পত্তি সাধারণত সমান অংশে ভাগ হয়।
উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয়:
- হিন্দু উত্তরাধিকার আইনটি মূলত হিন্দু যৌথ পরিবার ও কপার্থক সম্পত্তির ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
- ২০০৫ সালের আইন সংশোধনী অনুযায়ী, মেয়েরা সম্পত্তির ক্ষেত্রে সমান অংশ পাওয়ার অধিকার পেয়েছে, যা নারী অধিকারের ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ।
- উইল বা ইচ্ছাপত্রের প্রভাবও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা পিতার ইচ্ছার ভিত্তিতে সম্পত্তি বণ্টনকে নির্ধারণ করে।
এই আইন অনুসারে, হিন্দু বাবার সম্পত্তি সমানভাবে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বন্টিত হয় এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যেমন স্ত্রী ও মা, তারাও উত্তরাধিকার হিসেবে অংশ পায়।
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বাবার সম্পত্তি বন্টন আইন
বাংলাদেশে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য বাবার সম্পত্তি বন্টন আইনের ক্ষেত্রে প্রধানত ব্রিটিশ আমলের আইন অনুসরণ করা হয়, যা ভারতীয় উত্তরাধিকার আইন, ১৯২৫ দ্বারা প্রভাবিত। এই আইনের অধীনে বাবার সম্পত্তি ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী এবং অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে বন্টিত হয়। এখানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সম্পত্তি বন্টনের মূল বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো:
১. বাবার সম্পত্তির উইল থাকলে
খ্রিস্টান বাবার মৃত্যুর আগে যদি তিনি উইল (ইচ্ছাপত্র) তৈরি করে যান, তবে তার সম্পত্তি সেই উইল অনুযায়ী বন্টিত হবে। উইল থাকলে সম্পত্তি যেভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, সেভাবেই তা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ভাগ করা হবে।
- যদি উইল সঠিকভাবে তৈরি হয় এবং আইনি প্রক্রিয়া মেনে চলে, তাহলে সেই উইল অনুযায়ী বণ্টন করতে হবে।
- যদি উইল না থাকে, তবে উত্তরাধিকার আইনের নিয়মে সম্পত্তি বন্টিত হবে।
২. বাবার সম্পত্তির উইল না থাকলে
যদি খ্রিস্টান বাবা উইল না করে যান, তবে সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত নিয়ম প্রযোজ্য হবে:
- স্ত্রীর অংশ: বাবার মৃত্যু হলে তার স্ত্রী সম্পত্তির ১/৩ অংশ পায়।
- ছেলে ও মেয়েদের অংশ: বাকি ২/৩ অংশ ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হয়। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের আইনে ছেলে-মেয়েরা সম্পত্তির সমান অংশের অধিকারী হয়।
- পিতামাতার অংশ: যদি বাবা-মা জীবিত থাকেন, তারা সন্তানের সম্পত্তির কিছু অংশ পেতে পারেন, তবে সেটা নির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে নির্ধারিত হয়।
৩. বৈধ সন্তান না থাকলে সম্পত্তি বন্টন
যদি বাবার বৈধ সন্তান না থাকে, তাহলে সম্পত্তির বন্টন অন্যান্য নিকটাত্মীয়দের মধ্যে করা হয়:
- যদি সন্তান না থাকে, তাহলে সম্পত্তির ১/২ অংশ স্ত্রীর জন্য এবং বাকি ১/২ অংশ পিতামাতা বা অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ভাগ হয়।
- যদি স্ত্রী না থাকেন, তবে পুরো সম্পত্তি বাবা-মা বা অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ভাগ হয়।
৪. বিবাহ-বহির্ভূত সন্তানদের অংশ
খ্রিস্টান উত্তরাধিকার আইনের অধীনে, সাধারণত বিবাহ-বহির্ভূত সন্তানদের উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পত্তির কোনো অধিকার নেই। তবে, যদি পিতা বিশেষভাবে উইলে তাদের জন্য সম্পত্তির অংশ রেখে যান, তাহলে তারা সেই অংশের অধিকারী হতে পারে।
৫. অবিবাহিত সন্তানের সম্পত্তি বন্টন
যদি একজন অবিবাহিত খ্রিস্টান ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেন এবং তার কোনো সন্তান না থাকে, তাহলে তার সম্পত্তি পিতামাতা এবং ভাইবোনদের মধ্যে ভাগ করা হয়।
- পিতামাতা জীবিত থাকলে, তারা সন্তানের সম্পত্তির অধিকার পাবেন।
- পিতামাতা না থাকলে, ভাইবোনেরা সম্পত্তির সমান অংশ পাবে।
সম্পত্তি বন্টনের সহজ টিপস
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সম্পত্তি বন্টনের প্রক্রিয়া সহজ করতে কিছু টিপস অনুসরণ করা যেতে পারে:
- উইল তৈরি করা: বাবার মৃত্যুর পূর্বে একটি সঠিক উইল তৈরি করলে, সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে কোনো বিরোধ তৈরি হবে না।
- পারিবারিক আলোচনা: উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সুস্পষ্ট আলোচনা ও সমঝোতা সম্পত্তি বণ্টনের প্রক্রিয়াকে সহজ করতে পারে।
- আইনি পরামর্শ নেওয়া: সম্পত্তি বণ্টনের সময় অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নিলে প্রক্রিয়াটি সহজ ও নির্ভুল হবে।
উল্লেখযোগ্য বিষয়:
- খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে উইলের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উইল থাকলে সেটির নির্দেশ অনুযায়ী বণ্টন করতে হবে।
- ছেলে-মেয়ে উভয়েরই সমান অধিকার রয়েছে, যা আইনের একটি বিশেষ দিক।
- সন্তান না থাকলে সম্পত্তি বন্টনের নিয়ম ভিন্ন হয় এবং নিকটাত্মীয়দের মধ্যে ভাগ করা হয়।
এই আইনগুলো অনুসরণ করে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বাবার সম্পত্তি সঠিকভাবে বন্টিত হয়, যা পরিবারে ন্যায়বিচার ও শান্তি নিশ্চিত করে।
আদালতের মাধ্যমে বাবার সম্পত্তি বন্টন: প্রক্রিয়া ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
যদি বাবার সম্পত্তি বন্টন নিয়ে পরিবারের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় বা সম্পত্তি বণ্টনে কোনো আইনি জটিলতা সৃষ্টি হয়, তখন আদালতের মাধ্যমে সম্পত্তি বন্টন করতে হয়। আদালতের মাধ্যমে সম্পত্তি বন্টনের প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আইনি প্রক্রিয়াগুলো সঠিকভাবে অনুসরণ করা আবশ্যক। এখানে আদালতের মাধ্যমে সম্পত্তি বন্টনের প্রক্রিয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো ব্যাখ্যা করা হলো:
১. মামলা দায়ের করা
যদি পরিবারের সদস্যরা বাবার সম্পত্তি বন্টনে একমত না হন, তাহলে যেকোনো একজন উত্তরাধিকারী আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন। এটি সাধারণত “বণ্টন মামলা” নামে পরিচিত।
- মামলা দায়েরের স্থান: সম্পত্তি যেখানেই থাকুক না কেন, সংশ্লিষ্ট এলাকার নিম্ন আদালতে এই মামলা দায়ের করা হয়।
- দরকারি কাগজপত্র: সম্পত্তির দলিল, উত্তরাধিকারীদের তথ্য, এবং বাবার সম্পত্তির বিবরণ সংক্রান্ত সকল নথি দাখিল করতে হবে।
২. সম্পত্তি মূল্যায়ন
মামলা দায়েরের পর, আদালত সম্পত্তির সঠিক মূল্যায়ন করে।
- ম্যাপিং ও সার্ভে: আদালত সম্পত্তির সঠিক অবস্থান, আয়তন, এবং বৈধতা নিশ্চিত করতে সরকারী সার্ভেয়ার দ্বারা সম্পত্তির মানচিত্র প্রস্তুত করতে বলে।
- মুল্য নির্ধারণ: সম্পত্তির বাজারমূল্য নির্ধারণের জন্য আদালত প্রয়োজনীয় কর্তৃপক্ষের সাহায্য নেয়, যাতে সঠিক ভাগ করা যায়।
৩. আইনি জটিলতার সমাধান
অনেক ক্ষেত্রে সম্পত্তির ওপর একাধিক দাবি, বকেয়া ঋণ, বা অতিরিক্ত মালিকানার প্রশ্ন দেখা দেয়। আদালত এই সমস্ত জটিলতাগুলো সমাধান করার জন্য তদন্ত শুরু করে।
- ঋণ পরিশোধ: যদি বাবার ঋণ থেকে যায়, তাহলে সম্পত্তি বণ্টনের আগে সেই ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
- বৈধ উত্তরাধিকারীদের সনাক্তকরণ: আদালত সকল উত্তরাধিকারীর সঠিকতা যাচাই করে এবং যারা সম্পত্তির দাবিদার, তাদের অংশ সঠিকভাবে নির্ধারণ করে।
৪. আদালতের রায় ও সম্পত্তি বণ্টন
সমস্ত তদন্ত এবং প্রমাণ উপস্থাপন শেষে আদালত চূড়ান্ত রায় দেয়। এই রায় অনুযায়ী সম্পত্তি বন্টনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
- রায় কার্যকর করা: আদালতের রায় কার্যকর করতে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় সম্পত্তি ভাগ করে দেওয়া হয়।
- আপিলের সুযোগ: যদি কোনো পক্ষ আদালতের রায়ে অসন্তুষ্ট থাকে, তাহলে উচ্চ আদালতে আপিল করা যেতে পারে। তবে, আপিল না করলে নিম্ন আদালতের রায়ই চূড়ান্ত ধরা হবে।
৫. পারিবারিক সম্পত্তির বিভাজন
যদি পরিবারের সদস্যরা আদালতের মাধ্যমে বণ্টনে রাজি থাকে, তাহলে সম্পত্তি সমানভাবে ভাগ করা হয়। পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া আরও দ্রুত এবং সহজ হতে পারে।
- আনুষ্ঠানিক চুক্তি: আদালতের বাইরে বণ্টন করার সময়, পরিবারের মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো আইনি জটিলতা না ঘটে।
আদালতের মাধ্যমে সম্পত্তি বন্টনের সুবিধা ও অসুবিধা
সুবিধা
- আইনি সুরক্ষা: আদালতের মাধ্যমে সম্পত্তি বন্টন করলে আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত হয়, এবং সকল পক্ষের অধিকার রক্ষা পায়।
- নিরপেক্ষতা: আদালত সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে এবং আইন অনুযায়ী বণ্টনের রায় দেয়।
- দীর্ঘস্থায়ী সমাধান: আদালতের সিদ্ধান্তের পর, ভবিষ্যতে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের সম্ভাবনা কমে যায়।
অসুবিধা
- সময়সাপেক্ষ: আদালতের মাধ্যমে সম্পত্তি বন্টন প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ হতে পারে, বিশেষ করে যদি মামলাটি জটিল হয়।
- ব্যয়বহুল: আদালতের খরচ এবং আইনজীবী ফি বাবদ অনেক অর্থ ব্যয় হতে পারে।
- বিরোধ দীর্ঘায়িত হওয়া: যদি পরিবারের সদস্যরা আপিল করতে থাকে, তাহলে বিরোধের মীমাংসা দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে।
আদালতের মাধ্যমে সহজে সম্পত্তি বন্টনের টিপস
- প্রথমে আলোচনা: মামলা দায়েরের আগে পরিবারের মধ্যে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা উচিত।
- সঠিক কাগজপত্র জমা: আদালতে মামলা দায়েরের সময় প্রয়োজনীয় সকল নথি সঠিকভাবে জমা দেওয়া উচিত।
- অভিজ্ঞ আইনজীবীর সহায়তা নেওয়া: একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী সম্পত্তি বন্টন প্রক্রিয়ায় সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেন।
আদালতের মাধ্যমে বাবার সম্পত্তি বন্টন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া হতে পারে, তবে এটি একটি নিরপেক্ষ এবং আইনি সুরক্ষার মাধ্যম। তাই, পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে কোনো বিরোধ দেখা দিলে, আইন অনুযায়ী সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
.