ঢাকায় অ্যাপার্টমেন্টের দাম: মধ্যবিত্তের জন্য অধরা স্বপ্ন

ঢাকায় অ্যাপার্টমেন্টের দাম নিয়ে আলোচনা করা মানে মধ্যবিত্তের জন্য একটি হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরা। আমাদের রাজধানী শহরে অ্যাপার্টমেন্টের দাম অনেক আগে থেকেই আকাশছোঁয়া, কিন্তু তারপরও প্রতিবছরই এই দাম আরও বেড়ে চলেছে। ফলস্বরূপ, ঢাকার অধিকাংশ এলাকাতেই ফ্ল্যাট কেনা এখন মধ্যবিত্ত মানুষের সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে।

ঢাকার বর্তমান ফ্ল্যাটের দাম

বর্তমানে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের গড় দাম ১৪৩ দশমিক ৩১ মার্কিন ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ১৫ হাজার টাকার মতো (প্রতি ডলার ১০৫ টাকা ধরে)। এই দামে ১ হাজার ২০০ বর্গফুট আয়তনের একটি ফ্ল্যাটের দাম দাঁড়ায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তবে প্রতি বর্গফুটের গড় দাম ১৫ হাজার টাকা থাকলেও ঢাকার হাতে গোনা কয়েকটি এলাকায় এখনো ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকায় মাঝারি মানের ফ্ল্যাট কিনতে পাওয়া যায়।

  • গড় দাম: প্রতি বর্গফুট ১৪৩.৩১ ডলার বা প্রায় ১৫ হাজার টাকা।
  • ১২০০ বর্গফুট ফ্ল্যাট: প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা।


flat rate in Dhaka

ঢাকার প্রধান এলাকাগুলোর ফ্ল্যাটের দাম

গুলশান

গুলশান ঢাকার একটি অত্যন্ত অভিজাত এলাকা, যা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিস, দূতাবাস, এবং বিলাসবহুল আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানকার অ্যাপার্টমেন্টের দাম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য অধরা স্বপ্নই বলা চলে

  • প্রতি বর্গফুট গড় দাম: ১৬৬ ডলার বা ১৭,৪৩০ টাকা।
  • গুলশান ২ নম্বর: প্রতি বর্গফুট ১৮-২০ হাজার টাকা।
  • নর্থ গুলশান: প্রতি বর্গফুট ২০-২৫ হাজার টাকা।

 

বারিধারা

বারিধারা ঢাকার আরেকটি উচ্চবিত্ত ও অভিজাত আবাসিক এলাকা, যা বিশেষ করে কূটনৈতিক এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে।

  • প্রতি বর্গফুট গড় দাম: ১৬০.৭৪ ডলার বা ১৬,৮৭৮ টাকা।

বনানী

বনানী ঢাকার একটি বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকা, যা বিভিন্ন অফিস, রেস্তোরাঁ, স্কুল, হাসপাতাল এবং শপিং মলের উপস্থিতির জন্য পরিচিত। এটি উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের জন্য একটি জনপ্রিয় বসবাসের জায়গা হলেও, এখানকার আবাসন মূল্যও বেশ চ্যালেঞ্জিং

  • প্রতি বর্গফুট গড় দাম: ১২১.৩৬ ডলার বা ১২,৭৪৩ টাকা।

উত্তরা

  • প্রতি বর্গফুট গড় দাম: ১১৫.১৯ ডলার বা ১২,০৯৫ টাকা।

বসুন্ধরা

  • প্রতি বর্গফুট গড় দাম: ৯৭.১৬ ডলার বা ১০,২০২ টাকা।

মোহাম্মদপুর

  • প্রতি বর্গফুট গড় দাম: ৮৪.২৬ ডলার বা ৮,৮৪৭ টাকা।

মতিঝিল

  • প্রতি বর্গফুট গড় দাম: ৭৬.২৫ ডলার বা ৮,০০০ টাকা।

বাড্ডা

  • প্রতি বর্গফুট গড় দাম:৭৫.৬৯ ডলার বা ৭,৯৪৮ টাকা।

বনশ্রী

  • প্রতি বর্গফুট গড় দাম:৭২.২৬ ডলার বা ৭,৫৮০ টাকা।

শান্তিনগর

  • প্রতি বর্গফুট গড় দাম:৭০.৫৬ ডলার বা ৭,৪০৯ টাকা।

মিরপুর

  • প্রতি বর্গফুট গড় দাম:৬৯.১৭ ডলার বা ৭,২০০ টাকা।

মহাখালী

  • প্রতি বর্গফুট গড় দাম:৬৪.৬৯ ডলার বা ৬,৮০০ টাকা।

আগারগাঁও

  • প্রতি বর্গফুট গড় দাম:৬১.১১ ডলার বা ৬,৪০০ টাকা।

স্বল্প মূল্যের কিছু এলাকা

ঢাকার দক্ষিণখান, রামপুরা ও গেন্ডারিয়া এমন কিছু এলাকা যেখানে এখনো তুলনামূলক কম দামে ফ্ল্যাট পাওয়া যায়। দক্ষিণখানে গত বছর প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের গড় দাম ছিল ৬৫ ডলার বা ৬ হাজার ৮২৫ টাকা, যা ঢাকার গড় দামের চেয়ে অনেক কম। রামপুরায় প্রতি বর্গফুটের দাম ৫৭ ডলার বা ৫ হাজার ৯৮৫ টাকা এবং গেন্ডারিয়ায় ৫৯ ডলার বা ৬ হাজার ১৯ টাকা।

  • দক্ষিণখান: প্রতি বর্গফুট ৬৫ ডলার বা ৬,৮২৫ টাকা।
  • রামপুরা: প্রতি বর্গফুট ৫৭ ডলার বা ৫,৯৮৫ টাকা।
  • গেন্ডারিয়া: প্রতি বর্গফুট ৫৯ ডলার বা ৬,০১৯ টাকা।



 বৈশ্বিক মূল্যায়ন এবং স্থানীয় বাস্তবতা

রিসার্চ ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (আরআইইউ) একটি প্রতিবেদনমতে, পূর্বাচলে অ্যাপার্টমেন্টের দাম সবচেয়ে কম, অর্থাৎ প্রতি বর্গফুট ২৮ দশমিক ৩৭ ডলার বা ২ হাজার ৯৭৯ টাকা। যদিও রিহ্যাবের নেতারা মনে করেন, ঢাকায় এত কম দামে ফ্ল্যাট দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, নির্মাণসামগ্রীর দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে প্রতি বর্গফুটের নির্মাণ ব্যয়ই তিন হাজার টাকার বেশি।

  • পূর্বাচল: প্রতি বর্গফুট ২৮.৩৭ ডলার বা ২,৯৭৯ টাকা (তবে রিহ্যাবের মতে এত কমে ফ্ল্যাট দেওয়া সম্ভব নয়)।
  • নির্মাণ ব্যয়: প্রতি বর্গফুট নির্মাণ ব্যয় ৩ হাজার টাকার বেশি।

গত ১৩ বছরের ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিসংখ্যান

গত ১৩ বছরে ঢাকায় ১ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭ শতাংশ অ্যাপার্টমেন্ট নির্মিত হয়েছে গুলশানে, ২২ হাজার ৮৭৬টি। ধানমন্ডিতে ১৭ হাজার ৪৯৪টি, মোহাম্মদপুরে ১৪ হাজার ৮০২টি, মিরপুরে ১২ হাজার ১১১টি, বনানীতে ৮ হাজার ৭৪টি এবং উত্তরায় ৬ হাজার ৭২৮টি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মিত হয়েছে।

  • মোট নির্মিত ফ্ল্যাট: ১,৩৪,৫০০টি।
  • গুলশান: ২২,৮৭৬টি (১৭%)
  • ধানমন্ডি: ১৭,৪৯৪টি
  • মোহাম্মদপুর: ১৪,৮০২টি
  • মিরপুর: ১২,১১১টি
  • বনানী: ৮,০৭৪টি
  • উত্তরা: ৬,৭২৮টি







ফ্ল্যাটের দাম বৃদ্ধির কারণ


ঢাকায় অ্যাপার্টমেন্টের দাম বর্তমানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথমার্ধের দিকে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ব্যয় সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে। গত ১৩ বছরে ঢাকায় ফ্ল্যাটের দাম পৌনে দুই গুণ বেড়েছে। ২০১০ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের গড় দাম ছিল ৮১ দশমিক ২৬ ডলার। ২০১৯ সালে এটি বেড়ে ১২৪ দশমিক ৩৪ ডলার হয়। গত বছর সেটি বেড়ে এখন ১৪৩ ডলার ছাড়িয়েছে এই সমস্যার মূল কারণগুলি হলো:

জমির মূল্য বৃদ্ধি: ঢাকার মূল এলাকাগুলোতে জমির মূল্য বেড়ে যাওয়া একটি প্রধান কারণ। প্রতিটি স্কয়ার ফিট জমির দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা নির্মাণ ব্যয়কে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি: সিমেন্ট, রড, ইট, বালু ইত্যাদির মূল্য বৃদ্ধিও অ্যাপার্টমেন্টের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ। আন্তর্জাতিক বাজারেও এই সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে দেশীয় বাজারেও প্রভাব পড়েছে।

  • সাধারণ মানের প্রকল্প: প্রতি বর্গফুট নির্মাণ ব্যয় ৩,৭৯০ টাকা।
  • মাঝারি মানের ফ্ল্যাট: প্রতি বর্গফুট নির্মাণ ব্যয় ৪,৩০৫ টাকা।
  • অভিজাত ফ্ল্যাট: প্রতি বর্গফুট নির্মাণ ব্যয় ৫,৫০০ টাকা।

উচ্চ চাহিদা: ঢাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং নগরায়নের চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। এর ফলে আবাসন খাতের চাহিদাও বাড়ছে, যা মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

ব্যাংক ঋণের সুদের হার: ব্যাংক ঋণের সুদের হারও আবাসন খাতে বিনিয়োগের ওপর প্রভাব ফেলে। উচ্চ সুদের হারের কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পক্ষে ঋণ নিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে।

ভবিষ্যতের প্রত্যাশা

ভবিষ্যতে ফ্ল্যাটের দাম কমার সম্ভাবনা আছে কি না, জানতে চাইলে রিহ্যাবের সহসভাপতি সোহেল রানা বলেন, ‘করোনার পর ফ্ল্যাটের মূল্যবৃদ্ধির বড় কারণ নির্মাণসামগ্রীর উচ্চমূল্য। নির্মাণসামগ্রীর দাম যদি না কমে, তাহলে দাম কমানো সম্ভব নয়। তা ছাড়া নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) ভবন নির্মাণে উচ্চতাসংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপ আবাসন খাতের পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। আশা করছি, ড্যাপে সংশোধন আসবে, তা না হলে নতুন ড্যাপে ভবনের উচ্চতা নিয়ে বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে ফ্ল্যাটের দাম আরও বাড়বে।’

উপসংহার

ঢাকায় ফ্ল্যাটের দাম বৃদ্ধি একটি স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্যবিত্তদের জন্য একটি মানসম্মত ফ্ল্যাট ক্রয় করা ক্রমশই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। নির্মাণসামগ্রীর উচ্চমূল্য এবং জমির দাম এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে। তবে, ড্যাপের সংশোধন এবং নির্মাণসামগ্রীর দাম কমলে কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে আবাসন খাতের গ্রাহকরা। ততক্ষণ পর্যন্ত, মধ্যবিত্তদের জন্য ঢাকায় একটি মানসম্মত ফ্ল্যাট ক্রয় করা রয়ে যাবে কষ্টসাধ্য স্বপ্ন।

Join The Discussion

Compare listings

Compare
Open chat
Hello 👋
Can we help you?