ঢাকা শহর বাংলাদেশের রাজধানী এবং প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র। একসময় ঢাকায় ফ্ল্যাট কেনা ছিল মধ্যবিত্তদের জন্য স্বপ্ন বাস্তবায়নের মতো একটি বিষয়। তবে বর্তমানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, এবং রিয়েল এস্টেটের দামের ঊর্ধ্বগতির ফলে এই স্বপ্ন অনেকের জন্য দূরবর্তী হয়ে গেছে। তাহলে প্রশ্ন হলো, ঢাকায় কি এখনো মধ্যবিত্তরা ফ্ল্যাট কিনতে পারবে?
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি
২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৯% হারে। এই মূল্যস্ফীতির ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে, যার প্রভাব সরাসরি মধ্যবিত্তের জীবনে পড়েছে। সঞ্চয় করার সামর্থ্য কমে যাওয়ায় ফ্ল্যাট কেনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করা মধ্যবিত্তদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে।
ঢাকায় ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে কেন?
১. জমির অপ্রতুলতা: ঢাকায় জায়গার অভাব একটি বড় কারণ। প্রতিদিন গ্রামের থেকে শহরে মানুষ আসছে চাকরি বা উন্নত জীবনের আশায়, ফলে জমির চাহিদা বাড়ছে।
২. উন্নত পরিকাঠামো: রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, স্কুল, শপিং মল ইত্যাদির উন্নতি ও আধুনিকায়নের ফলে ঢাকায় ফ্ল্যাটের দাম বাড়ছে।
৩. উন্নতমানের ফ্ল্যাট: আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন ফ্ল্যাট তৈরির জন্য নির্মাণ ব্যয়ও বেড়েছে, যা সরাসরি ফ্ল্যাটের দামের উপর প্রভাব ফেলছে।
রিয়েল এস্টেটের বর্তমান অবস্থা
ঢাকার রিয়েল এস্টেট বাজারে ফ্ল্যাটের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। রিয়েল এস্টেট এন্ড হাউজিং এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (REHAB) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতে প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম প্রায় ২০,০০০ টাকা থেকে ৩০,০০০ টাকার মধ্যে। উদাহরণস্বরূপ, গুলশান, বনানী, এবং বারিধারার মতো এলাকাগুলোতে ১৫০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের দাম হতে পারে প্রায় ৩ কোটি থেকে ৪.৫ কোটি টাকা পর্যন্ত। অন্যদিকে, ঢাকার প্রান্তিক এলাকাগুলোতেও ফ্ল্যাটের দাম দ্রুত বাড়ছে, যেমন উত্তরা, মিরপুর, এবং বাড্ডা এলাকার ফ্ল্যাটের দাম প্রতি বর্গফুট ৮,০০০ টাকা থেকে ১৫,০০০ টাকা পর্যন্ত।
মধ্যবিত্তদের ফ্ল্যাট কেনার চ্যালেঞ্জ
মধ্যবিত্তদের জন্য ফ্ল্যাট কেনার প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো তহবিল। ফ্ল্যাটের দাম বেশি হওয়ার কারণে সহজে ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদের হারও অনেক বেশি। ফলে ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কেনা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যাংক ঋণ ও সুদের হার
মধ্যবিত্তরা সাধারণত ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে ফ্ল্যাট কেনার চেষ্টা করে। তবে বর্তমান সময়ে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১০% থেকে ১২% এর মধ্যে। এই উচ্চ সুদের হার ঋণ শোধ করা অনেকের জন্য কঠিন করে তুলছে। কিছু কিছু ব্যাংক বিশেষ সুবিধা প্রদান করলেও, তা সবসময় সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়।
সরকারি উদ্যোগ ও সহায়তা
বাংলাদেশ সরকার কিছু সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন প্রকল্প চালু করেছে, যেমন রাজউক এর আওতায় কিছু প্রকল্প রয়েছে যা মধ্যবিত্তদের জন্য সহজ শর্তে ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ প্রদান করে। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে “আশ্রয়ণ প্রকল্প” এর মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও সম্ভাবনা
ঢাকায় মধ্যবিত্তদের জন্য ফ্ল্যাট কেনার সম্ভাবনা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। কিছু পরিকল্পনা ও কৌশলের মাধ্যমে এই স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব:
1. বিকল্প এলাকা নির্বাচন: শহরের কেন্দ্রীয় স্থানগুলো বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম দামি এবং উন্নয়নশীল এলাকাগুলোতে ফ্ল্যাট কেনা।
2. কো-অপারেটিভ বা সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে ফ্ল্যাট কেনা: বেশ কয়েকজন মিলে একটি প্রজেক্টে বিনিয়োগ করে ফ্ল্যাট কিনতে পারে।
3. সঞ্চয় এবং বিনিয়োগ পরিকল্পনা: অল্প অল্প করে সঞ্চয় করে এবং সঠিক বিনিয়োগের মাধ্যমে ফ্ল্যাট কেনার অর্থ সংগ্রহ করা।
শেষ কথা
ঢাকায় ফ্ল্যাট কেনা বর্তমানে মধ্যবিত্তদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হলেও, এটি অসম্ভব নয়। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, রিয়েল এস্টেট বাজারে নিয়ন্ত্রণ, এবং সরকারের সহায়তায় এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করা সম্ভব। তাই, স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে হলে সঠিক পরিকল্পনা, সঞ্চয়, এবং সতর্কতার সাথে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন।