লিওনেল আন্দ্রেস মেসি যাকে আমরা চিনি লিওনেল মেসি নামে— এই একটি নাম যা শুধুমাত্র ফুটবলে নয়, বরং ক্রীড়ার ইতিহাসেও সোনার হরফে লেখা থাকবে। আর্জেন্টিনার এই বিস্ময় বালক ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন গেড়ে নিয়েছেন। বার্সেলোনা থেকে প্যারিস সেন্ট জার্মেই (পিএসজি) এবং বর্তমানে ইন্টার মায়ামিতে খেলা এই কিংবদন্তি তার অভূতপূর্ব দক্ষতা, অসাধারণ গোলস্কোরিং সামর্থ্য এবং অনন্য নৈপুণ্যের মাধ্যমে ফুটবলবিশ্বে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।
শৈশব ও ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা
রোজারিওর এক ছোট্ট ছেলেটি
১৯৮৭ সালের ২৪ জুন, আর্জেন্টিনার সান্তা ফে প্রদেশের রোজারিও শহরে জন্মগ্রহণ করেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। তার বাবা হোর্হে মেসি ছিলেন একটি স্টিল ফ্যাক্টরির সুপারভাইজার, আর মা সেলিয়া কুচ্চিত্তিনি ছিলেন ম্যাগনেট তৈরির একটি ওয়ার্কশপের কর্মী। তবে তাদের পরিবার ছিল একেবারেই ফুটবলপ্রেমী। তার দুই বড় ভাই রদ্রিগো ও মাতিয়াস এবং দুই চাচাতো ভাই ম্যাক্সিমিলিয়ানো ও ইমানুয়েল বিয়ানকুচ্চি—সবাই ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই ছোট লিওনেলও ফুটবলের প্রেমে পড়ে যান।
মেসির ফুটবলে আগ্রহ গড়ে ওঠে তার নানী সেলিয়া-এর কারণে। ছোটবেলায় মেসির নানী তাকে মাঠে নিয়ে যেতেন এবং খেলতে উৎসাহ দিতেন। তিনি কোচদের বোঝাতেন, “এই ছেলেটিকে সুযোগ দাও, একদিন দেখবে কত বড় খেলোয়াড় হবে!” কিন্তু যখন মেসি মাত্র ১০ বছর বয়সে তার নানীকে হারান, এটি তার জীবনের অন্যতম দুঃখের মুহূর্ত হয়ে ওঠে। সেই থেকে, আজও, যখনই মেসি গোল করেন, তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে তার নানীর উদ্দেশ্যে দুই হাত তুলে ইশারা করেন—যেনো তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন!
প্রথম ক্লাব: গ্রান্ডোলি ও নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ
মাত্র চার বছর বয়সে, মেসি তার বাবার অধীনে ফুটবল শেখা শুরু করেন এবং যোগ দেন রোজারিওর ছোট্ট একটি ক্লাব গ্রান্ডোলি-তে। প্রথম দিন থেকেই কোচদের চোখে পড়ে যান তিনি। অনেকে ভাবতেন, এত ছোটখাটো ও দুর্বল শারীরিক গঠনের এই ছেলেটি হয়তো ভালো খেলতে পারবে না, কিন্তু মাঠে নামার পর সবাই হতবাক হয়ে যেতেন! তার ড্রিবলিং, বলের নিয়ন্ত্রণ, গতি—সবই ছিল বয়সের তুলনায় অবিশ্বাস্য।
ছয় বছর বয়সে মেসি যোগ দেন রোজারিওর বিখ্যাত ক্লাব নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ-এ। এখানে তিনি ছিলেন সেই বিখ্যাত যুব দল “দ্য মেশিন অব ‘৮৭”-এর সদস্য, যারা প্রায় অপরাজিত ছিল! এই দলে খেলে ৬ বছরে তিনি প্রায় ৫০০ গোল করেন! খেলার সময় তিনি এতটাই প্রতিভাবান ছিলেন যে, নিউওয়েলসের মূল দলের ম্যাচের হাফটাইমে তার বল জাগলিং দেখানোর জন্য সমর্থকরা উন্মুখ হয়ে থাকতেন।
নিউওয়েলসের কোচ আদ্রিয়ান কোরিয়া প্রথম দিনেই বুঝেছিলেন, “এই ছেলেটি ফুটবলের জন্যই জন্মেছে!” তার ভাষায়,
“প্রথম দিন যখন আমি মেসিকে দেখলাম, আমি ভাবলাম—এত ছোট একটা ছেলের পক্ষে কি ফুটবল খেলা সম্ভব? কিন্তু মাঠে নেমেই সে প্রমাণ করলো, সে ব্যতিক্রমী প্রতিভাবান।”
গ্রোথ হরমোনের সমস্যা: বড় স্বপ্নের পথে বাধা
যখন মেসির বয়স ১০ বছর, তখন তার জীবনে বড় ধাক্কা আসে। তার শরীরে গ্রোথ হরমোনের ঘাটতি ধরা পড়ে, যার ফলে তার স্বাভাবিক উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল না। চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে প্রায় ৯০০ ডলার খরচ লাগত, যা তার পরিবারের জন্য ছিল অসম্ভব ব্যয়বহুল।
নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ এবং রিভার প্লেট ক্লাব শুরুতে প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে তার চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে অস্বীকৃতি জানায়। ঠিক তখনই আশার আলো হয়ে আসে বার্সেলোনা।
বার্সেলোনায় এক নতুন জীবন
২০০০ সাল, মাত্র ১৩ বছর বয়সী লিওনেল মেসি স্বপ্ন পূরণের আশায় পরিবারসহ পাড়ি জমান স্পেনের বার্সেলোনা শহরে। নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ ও রিভার প্লেট যখন তার চিকিৎসার খরচ বহনে অস্বীকৃতি জানায়, তখন তার পরিবার বিকল্প খুঁজতে থাকে। বার্সেলোনার স্কাউটদের নজরে পড়ে যায় এই প্রতিভাবান কিশোর।
মেসির ফুটবল প্রতিভা এতটাই চমকপ্রদ ছিল যে, এক বন্ধুর মাধ্যমে বার্সেলোনার স্পোর্টিং ডিরেক্টর চার্লি রেক্সাচ তার কথা জানতে পারেন। তখনই বার্সেলোনা ক্লাব কর্তৃপক্ষ তাকে ট্রায়ালের জন্য ডেকে পাঠায়।
এক কাগজের ন্যাপকিনে লেখা চুক্তিপত্র
ট্রায়ালের প্রথম দিনেই মেসির প্রতিভায় অভিভূত হন বার্সার কোচরা। কিন্তু এত অল্প বয়সী এক খেলোয়াড়কে দলে নেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে ক্লাব কর্তৃপক্ষ দ্বিধাগ্রস্ত ছিল।
ঠিক তখনই বার্সার স্পোর্টিং ডিরেক্টর চার্লি রেক্সাচ এক নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নেন। কোনো আনুষ্ঠানিক কাগজ না পেয়ে তিনি এক রেস্টুরেন্টে বসে একটি কাগজের ন্যাপকিনের ওপর চুক্তিপত্র লিখে দেন! তাতে লেখা ছিল:
“বার্সেলোনা লিওনেল মেসিকে দলে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
এই চুক্তির মাধ্যমেই মেসির বার্সেলোনা অধ্যায়ের সূচনা হয়। এরপর ক্লাব কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে তার পরিবারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং তার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় বহনের দায়িত্ব নেয়।
লা মাসিয়া: স্বপ্নের কারখানায় মেসির বিকাশ
বার্সেলোনার বিখ্যাত যুব একাডেমি “লা মাসিয়া”-তে যোগ দিয়েই মেসি তার প্রতিভার ঝলক দেখাতে শুরু করেন। তবে শুরুটা মোটেও সহজ ছিল না। প্রথমদিকে তিনি কাতালোনিয়ার ভাষা বুঝতে পারতেন না, ফলে দলের অন্যদের সঙ্গে ঠিকমতো মিশতে পারতেন না। এছাড়া, তার মা ও দুই ভাই আর্জেন্টিনায় ফিরে যান, আর মেসি ও তার বাবা স্পেনে থেকে যান। এই বিচ্ছেদ তাকে অনেক বেশি আবেগপ্রবণ করে তোলে।
তবে মাঠে নেমে মেসি অন্যরকম ছিলেন। বার্সার যুব দলের জন্য একের পর এক অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে দ্রুতই তিনি কোচদের চোখের মণি হয়ে ওঠেন। তার ড্রিবলিং, গতি, নিখুঁত পাসিং এবং গোল করার দক্ষতা তাকে অন্য সব খেলোয়াড়ের থেকে আলাদা করে তুলেছিল।
প্রথম দল ও সিনিয়র ক্যারিয়ারের শুরু
২০০৩ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে মেসি প্রথমবারের মতো বার্সেলোনার মূল দলের সঙ্গে অনুশীলনের সুযোগ পান। বার্সার তৎকালীন তারকা খেলোয়াড় রোনালদিনহো মেসির প্রতিভায় মুগ্ধ হন এবং তাকে ‘লিটল ব্রাদার’ বলে ডাকতে শুরু করেন।
১৬ নভেম্বর ২০০৩ সালে জোসে মরিনহোর পোর্তোর বিপক্ষে এক প্রীতি ম্যাচে মেসির প্রথম দলে অভিষেক হয়। এরপর ২০০৪ সালের ১৬ অক্টোবর, এস্পানিওলের বিপক্ষে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি লা লিগায় অভিষেক করেন।
এক বছরের মধ্যেই তার প্রতিভা সবার নজর কাড়ে এবং ২০০৫ সালের ১ মে, আলবাসেতের বিপক্ষে মেসি বার্সেলোনার হয়ে প্রথম গোল করেন, যা ছিল তার কিংবদন্তি হয়ে ওঠার পথে প্রথম ধাপ।
বার্সেলোনার হয়ে শুরু এক কিংবদন্তির যাত্রা
বার্সেলোনার বিখ্যাত লা মাসিয়া একাডেমি থেকে উঠে এসে লিওনেল মেসি ধীরে ধীরে ক্লাবের মূল দলে নিজের জায়গা করে নেন। তবে এই যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। বার্সেলোনার মতো বড় ক্লাবে জায়গা পাওয়ার জন্য শুধু প্রতিভা যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন ছিল ধৈর্য, কঠোর পরিশ্রম ও আত্মনিবেদন। মেসি সেই সবকিছুর মিশেলে গড়ে তুলেছিলেন নিজেকে, যা পরবর্তীতে তাকে বিশ্বের সেরা ফুটবলারদের কাতারে নিয়ে গিয়েছে।
২০০৪-০৫: প্রথম লা লিগা ম্যাচ ও প্রথম গোল
২০০৪ সালের ১৬ অক্টোবর, মাত্র ১৭ বছর ৩ মাস বয়সে লিওনেল মেসি বার্সেলোনার হয়ে লা লিগায় অভিষেক করেন এস্পানিওলের বিপক্ষে ম্যাচে। সেই সময় তিনি ছিলেন বার্সার ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় যিনি লিগে মাঠে নেমেছিলেন। তবে আসল ইতিহাস তৈরি হয় ২০০৫ সালের ১ মে, যখন আলবাসেতের বিপক্ষে ম্যাচে তিনি তার প্রথম গোল করেন। কিংবদন্তি রোনালদিনহোর পাস থেকে পাওয়া বলে এক নিখুঁত চিপ শটে মেসি তার প্রথম গোলটি করেন, যা ছিল ভবিষ্যতের অনেক মহাকাব্যিক গোলের সূচনা।
২০০৬-০৮: নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করা ও প্রথম বড় অর্জন
২০০৬ সালে মেসি প্রথমবারের মতো বার্সেলোনার হয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতেন, যদিও তিনি ফাইনালে খেলতে পারেননি চোটের কারণে। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি দলের অপরিহার্য সদস্য হয়ে উঠেছিলেন।
২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে মেসি এমন একটি গোল করেন যা আজও ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম সেরা গোল হিসেবে বিবেচিত হয়। গেটাফের বিপক্ষে করা সেই গোলটি ছিল ১৯৮৬ বিশ্বকাপে দিয়েগো ম্যারাডোনার করা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিখ্যাত গোলটির পুনরাবৃত্তি! মেসি বল ধরে একে একে ছয়জন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গোল করেছিলেন, যা তাকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে এবং তিনি “নতুন ম্যারাডোনা” উপাধি পান।
সেই মৌসুমেই তিনি লা লিগার ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে “এল ক্লাসিকোতে” (রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে) এক ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন, যা ফুটবলবিশ্বে তাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়।
২০০৮-১২: বার্সেলোনার সেরা খেলোয়াড় হয়ে ওঠা
২০০৮ সালে বার্সেলোনা নতুন কোচ পেপ গার্দিওলাকে নিয়োগ দেয়, আর তখনই মেসির ক্যারিয়ারে এক নতুন মোড় নেয়। গার্দিওলা মেসির প্রতিভা পুরোপুরি কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং তাকে বার্সেলোনার আক্রমণের মূল অস্ত্র হিসেবে গড়ে তোলেন।
- ২০০৮-০৯ মৌসুমে মেসি বার্সেলোনাকে তাদের ইতিহাসের প্রথম “ট্রেবল” জেতাতে সাহায্য করেন—লা লিগা, কোপা দেল রে ও উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ।
- চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে এক অসাধারণ হেড করে গোল করেন, যা বার্সেলোনাকে ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব এনে দেয়।
- ২০০৯ সালে তিনি প্রথমবারের মতো ব্যালন ডি’অর জেতেন, যা বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি।
এরপর থেকেই মেসি বার্সেলোনার মূল খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন এবং ক্লাবকে একের পর এক শিরোপা এনে দেন।
২০১২: রেকর্ড ভাঙার বছর
২০১২ সাল ছিল মেসির ক্যারিয়ারের অন্যতম স্মরণীয় বছর। এই বছর তিনি:
- এক ক্যালেন্ডার বছরে ৯১টি গোল করে বিশ্বরেকর্ড গড়েন।
- এক মৌসুমে ৫০টি লা লিগা গোল করে লিগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।
- চতুর্থ ব্যালন ডি’অর জেতেন, যা টানা চারবার কোনো ফুটবলারের জেতার প্রথম নজির ছিল।
বার্সেলোনার হয়ে অর্জনসমূহ
বার্সেলোনার হয়ে ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে মেসি:
- ১০টি লা লিগা শিরোপা
- ৪টি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ
- ৭টি কোপা দেল রে
- ৮টি সুপারকোপা দে এস্পানিয়া
- ৩টি উয়েফা সুপার কাপ
- ৩টি ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জেতেন।
লা মাসিয়া একাডেমি থেকে উঠে আসা ছোট্ট লিওনেল মেসি ধীরে ধীরে ফুটবলের মহাতারকায় পরিণত হন। বার্সেলোনার হয়ে তার এই অসাধারণ যাত্রা কেবল একটি ক্লাব ক্যারিয়ার নয়, বরং ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধ্যায়। তার প্রতিভা, কঠোর পরিশ্রম এবং খেলায় নিবেদন তাকে সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
পিএসজি ও ইন্টার মায়ামি অধ্যায়: নতুন চ্যালেঞ্জ ও নতুন দিগন্ত
বার্সেলোনা থেকে বিদায়: এক আবেগঘন অধ্যায়ের সমাপ্তি
প্রায় ১৭ বছর বার্সেলোনার হয়ে খেলার পর ২০২১ সালে মেসিকে বাধ্য হয়ে ক্লাব ছাড়তে হয়। বার্সেলোনা তখন তীব্র আর্থিক সংকটে ছিল এবং লা লিগার ফিন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লে নিয়মের কারণে তারা মেসির নতুন চুক্তির জন্য পর্যাপ্ত অর্থ জোগাড় করতে পারেনি। ফলে, ২০২১ সালের ৫ আগস্ট, ক্লাব আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে যে মেসি আর বার্সেলোনায় থাকতে পারছেন না।
৮ আগস্ট, ক্যাম্প নউয়ে এক আবেগঘন সংবাদ সম্মেলনে অশ্রুসজল মেসি বিদায় জানান তার শৈশবের ক্লাবকে। সেদিন তিনি বলেছিলেন,
“আমি সবসময় ভেবেছিলাম, বার্সেলোনা ছেড়ে যাবো না। কিন্তু বাস্তবতা আমাকে বাধ্য করেছে অন্য সিদ্ধান্ত নিতে।”
প্যারিস সেন্ট-জার্মেইন (পিএসজি): এক নতুন যাত্রার শুরু
বার্সেলোনা ছাড়ার পর, ফুটবলবিশ্বের অন্যতম ধনী ক্লাব প্যারিস সেন্ট-জার্মেইন (পিএসজি) দ্রুতই মেসিকে দলে ভেড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ১০ আগস্ট ২০২১, মেসি দুই বছরের চুক্তিতে পিএসজিতে যোগ দেন, যেখানে তিনি পুরনো বার্সা সতীর্থ নেইমার এবং ফ্রান্সের তারকা খেলোয়াড় কিলিয়ান এমবাপ্পের সঙ্গে জুটি বাঁধেন।
পিএসজিতে প্রথম মৌসুম (২০২১-২২): নতুন দলের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া
মেসির জন্য প্রথম মৌসুমটি ছিল চ্যালেঞ্জিং। নতুন দেশ, নতুন লিগ এবং নতুন কৌশলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লেগেছিল।
- ২৯ আগস্ট, স্টেড রেমসের বিপক্ষে লিগ ওয়ানে অভিষেক হয় মেসির।
- ২৮ সেপ্টেম্বর, ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে প্রথম গোল করেন।
- পুরো মৌসুমে তিনি ১১ গোল ও ১৪ অ্যাসিস্ট করেন এবং পিএসজিকে লিগ ওয়ান শিরোপা এনে দেন।
তবে এই মৌসুমে তার গোলসংখ্যা তুলনামূলক কম থাকায় অনেক সমালোচনা হয়।
পিএসজিতে দ্বিতীয় মৌসুম (২০২২-২৩): ফিরে আসার বছর
দ্বিতীয় মৌসুমে মেসি তার পুরনো ছন্দ ফিরে পান এবং দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন।
- পুরো মৌসুমে তিনি ২১ গোল ও ২০ অ্যাসিস্ট করেন।
- ২০২২ সালে, কাতার বিশ্বকাপ জয়ের পর, তিনি আবারও বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের কাতারে নিজের জায়গা দৃঢ় করেন।
- এই মৌসুমে তিনি পিএসজির হয়ে দ্বিতীয় লিগ ওয়ান শিরোপা জেতেন এবং মৌসুম শেষে ক্লাব ছাড়ার ঘোষণা দেন।
২০২৩ সালের ৩ জুন, পিএসজির কোচ নিশ্চিত করেন যে মেসির পিএসজির হয়ে এটিই শেষ ম্যাচ।
ইন্টার মায়ামিতে যোগদান: ফুটবলের নতুন দিগন্ত
পিএসজি ছাড়ার পর মেসির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা তৈরি হয়। সৌদি আরবের ক্লাব আল-হিলাল তাকে বিশাল অঙ্কের প্রস্তাব দেয় এবং বার্সেলোনাও চেষ্টা করছিল তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু মেসি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সিদ্ধান্ত নেন—তিনি মেজর লিগ সকার (MLS)-এর ক্লাব ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেন।
কেন ইন্টার মায়ামি?
মেসি এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
“আমি ইউরোপ ছাড়ার পর এমন একটা জায়গায় যেতে চেয়েছিলাম যেখানে আমি পরিবারকে সময় দিতে পারবো এবং ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা ধরে রাখতে পারবো।”
ইন্টার মায়ামির মালিক ছিলেন মেসির আদর্শ ডেভিড বেকহ্যাম। এছাড়া, মায়ামি শহরেও অনেক লাতিন আমেরিকান বসবাস করেন, যা মেসির পরিবারের জন্য একটি সুবিধাজনক বিষয় ছিল।
ইন্টার মায়ামিতে অভিষেক ও প্রথম সাফল্য
২১ জুলাই ২০২৩, মেসি ক্রুজ আজুলের বিপক্ষে ইন্টার মায়ামির হয়ে অভিষেক করেন এবং দুর্দান্ত ফ্রি-কিক গোল করে দলের জয় নিশ্চিত করেন। তার এই গোল পুরো বিশ্বে আলোড়ন তোলে।
- ৯ ম্যাচে ১০ গোল করে ইন্টার মায়ামিকে লিগস কাপ জেতান।
- এটি ছিল ক্লাবের ইতিহাসের প্রথম বড় ট্রফি।
- ২০২৪ সালের শুরুতেই, তিনি মেজর লিগ সকারের (MLS) ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে এক ম্যাচে ৫টি অ্যাসিস্ট করার রেকর্ড গড়েন।
মেসির লিগস কাপ জয়: নতুন ইতিহাস
মেসির ইন্টার মায়ামিতে আসার পর দলের পারফরম্যান্স নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। ১৯ আগস্ট ২০২৩, ইন্টার মায়ামি নাশভিলকে হারিয়ে লিগস কাপ জেতে এবং মেসি সর্বোচ্চ গোলদাতা ও টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হন।
২০২4 মৌসুম: নতুন রেকর্ডের পথে
২০২৪ মৌসুম শুরু হতেই মেসি আবারও নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন।
- মেজর লিগ সকারে (MLS) এক ম্যাচে ৬টি গোল-অ্যাসিস্ট (২ গোল, ৪ অ্যাসিস্ট) করে ইতিহাস গড়েন।
- মায়ামির হয়ে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন।
- ইন্টার মায়ামির হয়ে অল টাইম সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।
বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজি এবং তারপর ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেওয়া—মেসির ক্যারিয়ারের এই নতুন অধ্যায় তার খেলার প্রতি ভালোবাসারই প্রমাণ। ইউরোপীয় ফুটবল ছেড়ে আমেরিকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুললেও, মেসি প্রমাণ করেছেন যে তিনি শুধু ইউরোপের জন্যই নন—তিনি সারা বিশ্বের ফুটবল ভক্তদের জন্য এক মহাতারকা।
তার প্রতিভা, নেতৃত্ব এবং ফুটবলের প্রতি নিবেদন তাকে সব সময় ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখবে। ⚽🔥
আর্জেন্টিনার হয়ে মহাকাব্যিক অর্জন
জাতীয় দলের সঙ্গে শুরুটা কঠিন ছিল
লিওনেল মেসি বার্সেলোনায় যখন একের পর এক শিরোপা জিতছিলেন, তখন আর্জেন্টিনার হয়ে তার যাত্রা অতটা সহজ ছিল না। শৈশব থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জেতার, কিন্তু প্রথম দিকে জাতীয় দলের হয়ে তার সাফল্য আসছিল না।
- ২০০৪ সালে আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব-২০ দলে সুযোগ পান এবং ২০০৫ সালের ফিফা যুব বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন। তিনি ৬ গোল করে দলকে শিরোপা জিতিয়ে দেন এবং গোল্ডেন বল ও গোল্ডেন বুট জেতেন।
- ২০০৬ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে আর্জেন্টিনার সিনিয়র দলে অভিষেক করেন, কিন্তু বিশ্বকাপে তার দল কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে যায়।
- ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে, তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে স্বর্ণপদক জেতেন। এটি ছিল তার ক্যারিয়ারের প্রথম বড় আন্তর্জাতিক অর্জন।
কিন্তু সিনিয়র দলে ট্রফি জেতার স্বপ্ন যেন অধরা থেকে যাচ্ছিল।
একটি যুগের হতাশা: টানা তিনটি ফাইনাল হার
২০১০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার নেতৃত্বে ছিলেন দিয়েগো ম্যারাডোনা। সবাই আশা করেছিল, মেসি হয়তো ম্যারাডোনার পথ অনুসরণ করে দলকে বিশ্বকাপ এনে দেবেন। কিন্তু দল কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত হয়।
এরপরের বছরগুলো আরও হতাশাজনক ছিল।
- ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল: মেসির নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখায় এবং ফাইনালে পৌঁছে যায়। কিন্তু জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালে ১-০ গোলে হেরে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়।
- ২০১৫ কোপা আমেরিকা ফাইনাল: চিলির বিপক্ষে টাইব্রেকারে পরাজয়।
- ২০১৬ কোপা আমেরিকা সেন্টেনারিও ফাইনাল: আবারও চিলির বিপক্ষে টাইব্রেকারে হার, যা মেসির ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কষ্টদায়ক মুহূর্তগুলোর একটি।
এই তিনটি টানা ফাইনাল হারার পর, হতাশ মেসি জাতীয় দল থেকে অবসর ঘোষণা করেন। কিন্তু পুরো আর্জেন্টিনা তাকে ফিরে আসার অনুরোধ করে এবং কয়েক মাস পর তিনি ফিরে আসেন।
অপেক্ষার অবসান: ২০২১ কোপা আমেরিকা জয়
টানা ব্যর্থতার পর, ২০২১ কোপা আমেরিকা ছিল মেসির জন্য হয়তো শেষ সুযোগ। এইবার তিনি দারুণ ছন্দে ছিলেন।
- পুরো টুর্নামেন্টে তিনি ৪ গোল ও ৫ অ্যাসিস্ট করেন।
- ফাইনালে ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারিয়ে আর্জেন্টিনা ২৮ বছর পর প্রথম বড় শিরোপা জেতে।
- মেসি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন এবং গোল্ডেন বুটও জয় করেন।
ফাইনাল শেষে, চোখে জল নিয়ে মেসি বলেছিলেন:
“এটি আমার জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত। আমি সবসময় জাতীয় দলের হয়ে কিছু জিততে চেয়েছি, অবশেষে তা সম্ভব হলো!”
২০২২ বিশ্বকাপ: মহাকাব্যিক জয়
কোপা আমেরিকার পর আর্জেন্টিনা আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে তারা ফেভারিট হিসেবে খেলতে নামে। তবে প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের বিপক্ষে ২-১ গোলে হার দলকে ব্যাকফুটে নিয়ে যায়। কিন্তু এরপর যা হলো, তা ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গল্প।
- গ্রুপ পর্ব: মেক্সিকো ও পোল্যান্ডকে হারিয়ে আর্জেন্টিনা নকআউট রাউন্ডে যায়।
- রাউন্ড অফ ১৬: অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২-১ গোলে জয়, যেখানে মেসি একটি অসাধারণ গোল করেন।
- কোয়ার্টার ফাইনাল: নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে নাটকীয় টাইব্রেকারে জয়।
- সেমিফাইনাল: ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স, ৩-০ গোলে জয়। মেসির জাদুকরী অ্যাসিস্ট বিশ্বকে মুগ্ধ করে।
- ফাইনাল: আর্জেন্টিনা বনাম ফ্রান্স – ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ফাইনাল।
ফাইনালে মেসি ২ গোল করেন, এমবাপ্পে হ্যাটট্রিক করলেও টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনা জয় পায়। ৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জেতে, এবং মেসি গোল্ডেন বল জিতে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হন।
এই জয় শুধু একটি ট্রফি ছিল না, এটি ছিল মেসির অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের গল্প। বিশ্ব ফুটবলের রাজমুকুট অবশেষে তার মাথায় উঠলো!
২০২৪ কোপা আমেরিকা ও নতুন লক্ষ্য
বিশ্বকাপ জয়ের পর, মেসির নতুন লক্ষ্য ছিল ২০২৪ কোপা আমেরিকা জেতা। এইবারও তিনি দলের মূল নেতা হিসেবে ছিলেন এবং দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
- টুর্নামেন্টে তিনি একটি গোল ও একটি অ্যাসিস্ট করেন।
- কানাডার বিপক্ষে সেমিফাইনালে গোল করে ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক গোলদাতা হন।
- ফাইনালে কলম্বিয়াকে হারিয়ে আর্জেন্টিনা টানা দ্বিতীয়বার কোপা আমেরিকা জয় করে।
এটি ছিল মেসির ক্যারিয়ারের তৃতীয় বড় আন্তর্জাতিক ট্রফি, যা তাকে ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরাদের তালিকায় আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।
মেসির আন্তর্জাতিক অর্জনসমূহ
✅ ফিফা বিশ্বকাপ: ২০২২ 🏆
✅ কোপা আমেরিকা: ২০২১, ২০২৪ 🏆
✅ ফাইনালিসিমা: ২০২২ 🏆
✅ ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ: ২০০৫ 🏆
✅ বেইজিং অলিম্পিক স্বর্ণপদক: ২০০৮ 🏅
মেসি শুধু আর্জেন্টিনাকে ট্রফি এনে দেননি, তিনি পুরো জাতিকে একত্রিত করেছেন। ২০২২ বিশ্বকাপ জয়ের পর আর্জেন্টিনার রাস্তায় ৫০ লাখের বেশি মানুষ তার জয় উদযাপন করে, যা ফুটবল ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বিজয় উদযাপন।
আজকের দিনে, মেসি শুধু একজন ফুটবলার নন—তিনি আর্জেন্টিনার জন্য এক আবেগ, এক অনুভূতি। তার আন্তর্জাতিক অর্জন তাকে চিরকালের জন্য ফুটবলের মহাকাব্যিক নায়কে পরিণত করেছে। ⚽🇦🇷🔥