ফ্ল্যাট কেনার নিয়ম জানাটা খুবই জরুরি, কারণ এটি একটি বড় বিনিয়োগ এবং অনেক মানুষের জীবনের সঞ্চয়ের ফল। সঠিক নিয়ম মেনে না চললে অনেক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারেন। তাই, এই ব্লগে আমরা আলোচনা করবো কীভাবে সঠিক নিয়ম মেনে ফ্ল্যাট কেনা যায় এবং এর সুবিধা-অসুবিধা।
ফ্ল্যাট কেনার নিয়ম: কোন বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে?
ফ্ল্যাট কেনার নিয়ম মেনে চলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি একটি বড় আর্থিক বিনিয়োগ এবং ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষিত থাকার উপায়। ফ্ল্যাট কেনার সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখতে হবে, যা আপনার বিনিয়োগকে নিরাপদ করতে সহায়ক হবে। নিচে ফ্ল্যাট কেনার সময় যে বিষয়গুলো মাথায় রাখা উচিত তা আলোচনা করা হলো:
১. ডকুমেন্টেশন যাচাই-বাছাই
ফ্ল্যাট কেনার সময় ডকুমেন্টেশন যাচাই-বাছাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভুল বা অসম্পূর্ণ ডকুমেন্টের কারণে ভবিষ্যতে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। তাই কিছু গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট ভালোভাবে যাচাই করতে হবে:
- মালিকানা দলিল: যাচাই করুন যে বিক্রেতার কাছে ফ্ল্যাটের বৈধ মালিকানা দলিল আছে কিনা। দলিল দেখে নিশ্চিত হন যে এটি বর্তমান মালিকের নামে রেজিস্ট্রিকৃত এবং যথাযথভাবে সীলমোহর করা।
- মিউটেশন সার্টিফিকেট:ফ্ল্যাটের মালিকানা প্রমাণের জন্য মিউটেশন (নামজারি) সার্টিফিকেট অপরিহার্য। এটি দেখায় যে বর্তমান মালিকের নামে ফ্ল্যাটের রেকর্ড রয়েছে এবং স্থানীয় ভূমি অফিসে নামজারি সম্পন্ন হয়েছে কিনা।
- খতিয়ান ও দাগ নম্বর: ফ্ল্যাটের জমির খতিয়ান এবং দাগ নম্বর পরীক্ষা করুন। ফ্ল্যাটটি বৈধভাবে ভূমিতে স্থাপিত কিনা এবং কোনো জমির জটিলতায় আছে কিনা তা নিশ্চিত করুন।
- বিল্ডিং প্ল্যান এবং অনুমোদন: বিল্ডিং প্ল্যান এবং উন্নয়ন সংক্রান্ত সমস্ত অনুমোদন যথাযথ কতৃপক্ষ থেকে অনুমোদিত কিনা, তা যাচাই করা জরুরি। এটি নিশ্চিত করে যে ফ্ল্যাটটি সকল প্রয়োজনীয় আইন ও নীতিমালা অনুসারে নির্মিত হয়েছে।
- ট্যাক্স পরিশোধের প্রমাণপত্র : ফ্ল্যাটের উপর পূর্ববর্তী মালিকের ট্যাক্স পরিশোধ সংক্রান্ত কাগজপত্র পরীক্ষা করুন। পুরানো ট্যাক্স বকেয়া থাকলে, তা ভবিষ্যতে ক্রেতার উপর আরোপিত হতে পারে।
- ফ্ল্যাটের উন্নয়ন চুক্তি: ফ্ল্যাটের ডেভেলপারের সাথে মালিকের মধ্যে কোনো চুক্তি হলে, তা যাচাই করুন। উন্নয়ন চুক্তি অনুযায়ী ডেভেলপার তাদের প্রতিশ্রুতি মেনে চলেছে কিনা, তা নিশ্চিত করুন।
- বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সংযোগের কাগজপত্র: ফ্ল্যাটে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদির জন্য যথাযথ সংযোগ এবং বিল পরিশোধ সংক্রান্ত ডকুমেন্ট রয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করুন। এগুলো সঠিক থাকলে পরে অতিরিক্ত খরচ এড়ানো সম্ভব হবে।
এই ডকুমেন্টগুলো যাচাই করে নিশ্চিত হতে হবে যে ফ্ল্যাটটি আইনগতভাবে নিরাপদ এবং কোনো বিরোধপূর্ণ বিষয় নেই।
২. প্রকল্পের অনুমোদন ও লাইসেন্স
ফ্ল্যাট কেনার সময় প্রকল্পের অনুমোদন ও লাইসেন্স যাচাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি প্রকল্প আইনগতভাবে বৈধ কিনা, তা নিশ্চিত করার জন্য নিচের কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে:
- বিল্ডিং প্ল্যান অনুমোদন: ফ্ল্যাট নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ (যেমন RAJUK, CDA, বা অন্যান্য স্থানীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) থেকে বিল্ডিং প্ল্যান অনুমোদিত কিনা তা যাচাই করুন। এই অনুমোদন নিশ্চিত করে যে ভবনটি সঠিকভাবে নীতিমালা মেনে নির্মাণ করা হয়েছে।
- পরিবেশগত ছাড়পত্র : কোনো বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র থাকা বাধ্যতামূলক। এটি নিশ্চিত করে যে প্রকল্পটি পরিবেশগত দিক থেকে ক্ষতিকর নয় এবং সমস্ত পরিবেশগত নিয়ম মেনে তৈরি হয়েছে।
- জমি উন্নয়ন লাইসেন্স: প্রকল্পটি নির্মাণের জন্য যে জমি ব্যবহৃত হয়েছে, তা নিয়ে উন্নয়ন লাইসেন্স রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করুন। ডেভেলপারদের কিছু নির্দিষ্ট জমির ক্ষেত্রে উন্নয়নের অনুমোদন থাকতে হয়, যা স্থানীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে নেওয়া হয়।
- ফায়ার সেফটি লাইসেন্স: বিশেষ করে উচ্চতল ভবনের ক্ষেত্রে, ফায়ার সেফটি বা অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থার অনুমোদন থাকা বাধ্যতামূলক। এতে নিশ্চিত হয় যে ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি মোকাবিলায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
- উন্নয়ন সংক্রান্ত চুক্তিপত্র (Joint Venture Agreement): ফ্ল্যাটটি যদি জমির মালিক ও ডেভেলপারদের মধ্যে যৌথ উন্নয়ন প্রকল্পের (জয়েন্ট ভেঞ্চার) আওতায় হয়, তবে এই চুক্তির কাগজপত্র দেখতে হবে। এতে উভয় পক্ষের দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা নির্ধারিত থাকে।
- স্থায়ী অনুমতি এবং শেষ অনুমোদন (Occupancy Certificate): ফ্ল্যাট নির্মাণ কাজ শেষ হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে স্থায়ী অনুমতি (Occupancy Certificate) সংগ্রহ করা হয়। এটি নিশ্চিত করে যে ভবনটি বসবাসের উপযোগী এবং সমস্ত আইন মেনে তৈরি হয়েছে।
প্রকল্পের এইসব অনুমোদন ও লাইসেন্স যাচাই করা নিশ্চিত করে যে ভবনটি আইনগতভাবে বৈধ এবং ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হবে না।
৩. বিল্ডার বা ডেভেলপারের সুনাম ও অভিজ্ঞতা
বিশ্বাসযোগ্য ডেভেলপার বা বিল্ডার নির্বাচন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডেভেলপারের পূর্বের প্রকল্পগুলোর সাফল্য ও গ্রাহক প্রতিক্রিয়া যাচাই করে নিন। অভিজ্ঞ ডেভেলপারদের প্রকল্প সাধারণত সময়মতো সম্পন্ন হয় এবং মান বজায় রাখে।
৪. জমির মালিকানা ও লিগ্যাল ক্লিয়ারেন্স
ফ্ল্যাট কিনতে গেলে জমির মালিকানা নিয়ে কোনো বিতর্ক আছে কিনা তা ভালোভাবে যাচাই করতে হবে। এছাড়া জমির দলিল ও অন্যান্য বৈধতা যাচাই করার জন্য একজন দক্ষ আইনজীবীর পরামর্শ নিতে পারেন।
৬. ব্যাংক লোন সুবিধা ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা
ফ্ল্যাট কেনার আগে বাজেট পরিকল্পনা এবং ব্যাংক লোন সুবিধাগুলো দেখে নিতে হবে। অনেক সময় ব্যাংক কিছু নির্দিষ্ট ডেভেলপারের প্রজেক্টে ঋণ সুবিধা প্রদান করে থাকে, যা আপনার জন্য লাভজনক হতে পারে।
৭. ফ্ল্যাটের অবস্থান ও পরিবেশ
ফ্ল্যাট কেনার সময় তার অবস্থান, পরিবেশ এবং আশেপাশের এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া, কাছাকাছি বাজার, হাসপাতাল, স্কুল, এবং অন্যান্য জরুরি স্থাপনার সুবিধাগুলো দেখে নিন।
৮. রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ও সার্ভিস চার্জ
ফ্ল্যাট কেনার নিয়মের মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ও মাসিক সার্ভিস চার্জ সম্পর্কেও খোঁজ নেয়া জরুরি। কারণ এ খরচগুলি ভবিষ্যতে আর্থিকভাবে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
৯. পুনরায় বিক্রয় মূল্য (Resale Value)
ফ্ল্যাট কেনার আগে তার ভবিষ্যত পুনরায় বিক্রয় মূল্য (resale value) সম্পর্কে জানুন। ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে এটি বিক্রি করে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কেমন তা যাচাই করে নিন।
১০. ফ্ল্যাটের ভবিষ্যৎ মূল্যায়ন ও বাজার বিশ্লেষণ
ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে কিনা বা এলাকাটি উন্নয়নশীল কিনা এ বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় বাজারের মূল্যায়ন ও ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণা থাকলে বিনিয়োগ আরও সঠিক হবে।
১১. নির্মাণের গুণমান
ফ্ল্যাট কেনার সময় নির্মাণের গুণমান যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি। ভবনটির কাঠামো, ব্যবহার করা রড, সিমেন্ট, ইট, এবং অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর মান পরীক্ষা করে নিন। এছাড়া দেয়াল, মেঝে, এবং ছাদের স্থায়িত্বও পরীক্ষা করা দরকার।
১২. অ্যামেনিটিজ বা সুবিধাসমূহ
ফ্ল্যাটে আবাসিক সুবিধাসমূহ যেমন জিম, সুইমিং পুল, পার্কিং সুবিধা, সিকিউরিটি সিস্টেম, কমিউনিটি হল এবং খেলার মাঠ আছে কি না তা জেনে নিন। বর্তমান এবং ভবিষ্যতের চাহিদার কথা মাথায় রেখে এসব সুবিধা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
১৩. ফ্ল্যাটের ভেতরের স্পেস বা এলাকা
ফ্ল্যাটের অভ্যন্তরীণ এলাকা বা স্পেস কেমন তা নিশ্চিত করুন। কমপক্ষে দুই থেকে তিনটি বেডরুম, ড্রয়িং, ডাইনিং, এবং বাথরুমের যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা থাকা উচিত। আপনার পরিবারের সদস্যদের চাহিদা অনুযায়ী স্পেসের পরিকল্পনা করুন।
১৪. আলো-বাতাসের প্রবাহ
ফ্ল্যাটে পর্যাপ্ত আলো এবং বাতাসের ব্যবস্থা আছে কি না তা পরীক্ষা করে নিন। প্রকৃতির সাথে মিল রেখে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশ করলে ফ্ল্যাটটি বাসযোগ্য হয়ে ওঠে এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় থাকে।
১৫. সিকিউরিটি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা
ফ্ল্যাট কেনার নিয়মের মধ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও একটি বড় বিষয়। ভবনের সিকিউরিটি গার্ড, সিসিটিভি ক্যামেরা, ইন্টারকম সুবিধা, এবং ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা রয়েছে কি না তা যাচাই করুন। এটি আপনার পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করবে।
১৬. ফ্ল্যাটের ফিনিশিং ও ইন্টেরিয়র ডিজাইন
ফ্ল্যাটের টাইলস, রং, স্যানিটারি ফিটিংস, এবং দরজা-জানালার মান যাচাই করুন। প্রয়োজনে আপনি ইন্টেরিয়র ডিজাইন পরিবর্তন করতে চাইলে আগে থেকেই খরচ ও সময়ের বিষয়ে ধারণা নিন।
১৭. ফ্ল্যাট হস্তান্তর সময়সীমা
প্রকল্পটি কতদিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে এবং ফ্ল্যাট হস্তান্তর হবে সে বিষয়ে ডেভেলপারের সাথে আলোচনা করুন। নির্ধারিত সময়ে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হবে কিনা সে বিষয়ে ডেভেলপারের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করা জরুরি।
১৮. পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা
ফ্ল্যাটের কাছাকাছি যোগাযোগ ব্যবস্থা, যেমন বাস বা রেল স্টেশন, বড় রাস্তা, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানের সহজ লভ্যতা রয়েছে কি না তা দেখে নিন। এটি আপনার দৈনন্দিন চলাচলের জন্য সুবিধাজনক হবে।
১৯. ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা
ফ্ল্যাটের আশেপাশে ভবিষ্যতে কোন ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে তা জানুন। নতুন স্কুল, হাসপাতাল, বিপণিবিতান, বা রাস্তা নির্মাণ হলে এলাকাটির মূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে, যা আপনার জন্য লাভজনক হবে।
২০. অ্যাপার্টমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাপনা
ফ্ল্যাটে অ্যাসোসিয়েশন ব্যবস্থাপনা কেমন, এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা কীভাবে পরিচালিত হয় তা জেনে নিন। অ্যাসোসিয়েশন নিয়ম-কানুন, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, এবং অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা থাকলে ভবিষ্যতে ঝামেলা এড়ানো সহজ হবে।
২১. প্রতিবেশী ও সামাজিক পরিবেশ
আপনার ভবিষ্যত প্রতিবেশীরা কেমন, এবং এলাকার সামাজিক পরিবেশ কেমন তা বোঝার চেষ্টা করুন। নিরাপদ ও সুন্দর পরিবেশে থাকার জন্য একটি ভালো সামাজিক পরিবেশ প্রয়োজন।
২২. কর ও অন্যান্য ফি
ফ্ল্যাট কেনার সময় বিভিন্ন কর ও ফি যেমন রেজিস্ট্রেশন ফি, স্ট্যাম্প ডিউটি, এবং অন্যান্য চার্জ সম্পর্কে জেনে নিন। কেনার পূর্বেই এই অতিরিক্ত খরচের বিষয়টি বাজেটে যোগ করুন।
২৩. ফ্ল্যাটের প্রোপার্টি ট্যাক্স
প্রোপার্টি ট্যাক্স বা সম্পত্তি কর সম্পর্কে ধারণা রাখা গুরুত্বপূর্ণ। ফ্ল্যাট কেনার পরে এই করের বিষয়টি যাতে ভবিষ্যতে সমস্যা না সৃষ্টি করে, সে জন্য আগে থেকেই পরামর্শ নিন।
২৪. বিল্ডিং-এর বয়স এবং রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থা
পুরাতন ভবন কিনলে তার বর্তমান রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থা এবং ভবিষ্যতে কতটুকু রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হবে তা যাচাই করুন। নতুন এবং পুরাতন ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ খরচের ব্যবধানও বিবেচনায় আনুন।
ফ্ল্যাট কেনার সুবিধা
ফ্ল্যাট কেনার অনেক সুবিধা রয়েছে, যা একজন ক্রেতাকে স্থায়ী সম্পত্তির মালিকানা অর্জনে সহায়ক হতে পারে। নিম্নে ফ্ল্যাট কেনার কয়েকটি প্রধান সুবিধা আলোচনা করা হলো:
১. স্থায়ী মালিকানা
ফ্ল্যাট কেনার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো আপনি স্থায়ী মালিকানা লাভ করেন। বাড়ির মালিক হওয়ার মাধ্যমে ভাড়াটে হিসেবে থাকার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় এবং ভবিষ্যতে আর্থিকভাবে স্বাধীন থাকতে পারেন।
২. নিরাপত্তা ও সুরক্ষা
ফ্ল্যাটে সাধারণত সুরক্ষার ব্যবস্থা ভালো থাকে, যেমন ২৪ ঘণ্টার নিরাপত্তা, সিসিটিভি ক্যামেরা, এবং গেটের নিরাপত্তা। এসব সুবিধা আপনাকে নিরাপদ জীবনযাপন করতে সহায়ক।
৩. দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ
ফ্ল্যাট একটি দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ হতে পারে, কারণ এর মূল্য সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে পারে। এর মানে, আপনি যদি পরে এটি বিক্রি করতে চান, তবে লাভবান হতে পারেন।
৪. সহজ মেইনটেনেন্স
ফ্ল্যাটের রক্ষণাবেক্ষণ সাধারণত কম হয় কারণ অনেক ফ্ল্যাট কমিউনিটি বা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে তৈরি হয়, যেখানে সাধারণ ফ্যাসিলিটি মেইনটেন্যান্স এবং সাফসাফি জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকে।
৫. আধুনিক সুবিধা
ফ্ল্যাট প্রায়শই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা যেমন সুইমিং পুল, জিম, পার্কিং স্পেস, ল্যান্ডস্কেপিং, এবং পার্টি হলের মতো সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে, যা আপনার জীবনকে আরও আরামদায়ক এবং সুবিধাজনক করে তোলে।
৬. কমিউনিটি পরিবেশ
ফ্ল্যাটে বসবাস করার সময় আপনি একটি কমিউনিটি পরিবেশে থাকতে পারেন, যেখানে প্রতিবেশীরা কাছাকাছি থাকে। এটি সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার এবং পরিবারকে সুরক্ষিত রাখার জন্য সহায়ক হতে পারে।
৭. কমপ্যাক্ট ও স্থান সাশ্রয়ী
ফ্ল্যাটগুলো সাধারণত ছোট বা মধ্যম আকারে তৈরি হয়, যা শহরের মধ্যে স্থান সাশ্রয়ী হতে সহায়ক। এর ফলে আপনি শহরের কেন্দ্রীয় এলাকায় বসবাস করতে পারেন, যেখানে সাশ্রয়ী দাম এবং সুবিধাজনক পরিবহন ব্যবস্থা থাকে।
৮. ফিনান্সিং সুবিধা
ফ্ল্যাট কেনার জন্য ব্যাংক লোন পাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ। এর জন্য অনেক ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভাল সুদের হারে লোন প্রদান করে থাকে, যা আপনাকে সল্প সময়ে এবং সহজ শর্তে ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ দেয়।
৯. মালিকানা ও সম্পত্তির অধিকার
ফ্ল্যাট কেনার মাধ্যমে আপনি সম্পত্তির অধিকারী হন, এবং এটি আপনার ভবিষ্যতের জন্য একটি মূল্যবান অ্যাসেট হয়ে দাঁড়ায়। আপনি চাইলে এটি রেন্টে দিতে পারেন বা বিক্রি করে ভালো মুনাফা অর্জন করতে পারেন।
১০. সুবিধাজনক অবস্থান
ফ্ল্যাটগুলো সাধারণত শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে, যেমন অফিস, স্কুল, হাসপাতাল এবং শপিং মল এর কাছে থাকে। ফলে দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্য আপনি খুব কম সময়ে পৌঁছাতে পারবেন।
এই সুবিধাগুলোর মাধ্যমে, ফ্ল্যাট কেনা শুধু আপনার বসবাসের জন্য নয়, এটি একটি অর্থনৈতিক ও নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করতে পারে।
ফ্ল্যাট কেনার অসুবিধা
ফ্ল্যাট কেনার কিছু অসুবিধাও রয়েছে যা অনেক সময় ক্রেতাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। নিচে ফ্ল্যাট কেনার কিছু সাধারণ অসুবিধা আলোচনা করা হলো:
১. বেশি দাম
ফ্ল্যাটের দাম অনেক সময় খুবই বেশি হতে পারে, বিশেষ করে শহরের কেন্দ্রস্থলে বা জনপ্রিয় এলাকায়। এ ক্ষেত্রে, অনেকের জন্য পুরো অর্থ এককালীন পরিশোধ করা সম্ভব হয় না এবং তাদের ব্যাংক লোনের উপর নির্ভর করতে হয়। তবে ব্যাংক লোনের সুদের হার বেশি হতে পারে, যা ভবিষ্যতে আর্থিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
২. নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণের অভাব
ফ্ল্যাটের মালিক হওয়ার পরেও আপনার সম্পত্তির কিছু অংশের উপর নিয়ন্ত্রণ সীমিত থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কমপ্লেক্সের সেবা, মেইনটেন্যান্স, নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা নিয়ম-নীতির ক্ষেত্রে প্রতিবেশীদের সাথে সমন্বয় করতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে, এই নিয়ন্ত্রণের অভাব আপনাকে অসুবিধার মুখে ফেলতে পারে।
৩. কম বেসমেন্ট বা খোলামেলা স্থান
অনেক ফ্ল্যাটের মধ্যে খোলামেলা স্থান বা বেসমেন্টের অভাব থাকতে পারে। যদি আপনি প্রাকৃতিক পরিবেশ বা বড় আঙ্গিনা পছন্দ করেন, তবে ফ্ল্যাটে বসবাস আপনার জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে।
৪. সামাজিক এবং পরিবেশগত চাপ
ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স বা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে অনেক পরিবার একসাথে বসবাস করে, যা মাঝে মাঝে সামাজিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের সমস্যা, শব্দ দূষণ, বা পার্কিং স্পেসের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৫. মেইনটেনেন্স চার্জ
ফ্ল্যাটের মালিক হলে, আপনাকে মাসিক মেইনটেনেন্স চার্জ প্রদান করতে হয়। এই চার্জের পরিমাণ কখনও কখনও অনেক বেশি হতে পারে, এবং যদি প্রকল্পের উন্নয়ন বা রক্ষণাবেক্ষণের গুণগত মান খারাপ হয়, তবে আপনি বেশি পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে পারেন।
৬. বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ঝামেলা
ফ্ল্যাট কেনার পর যদি আপনি এটিকে ভাড়া দিতে চান, তবে কখনও কখনও ভাড়াটিয়া নির্বাচন এবং লিজের শর্তাবলী নিয়ে সমস্যা হতে পারে। এছাড়া, ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রে সময়ে সময়ে ঝামেলা হতে পারে।
৭. পরিবেশগত সমস্যা
কিছু ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স শহরের কেন্দ্রীয় এলাকায় অবস্থিত, যেখানে ধুলাবালি, শব্দদূষণ বা বায়ুদূষণ সমস্যা থাকতে পারে। এই কারণে, ফ্ল্যাটে বসবাস করলে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
৮. অপর্যাপ্ত পার্কিং স্পেস
অনেক ফ্ল্যাট কমপ্লেক্সে সীমিত পার্কিং স্পেস থাকে, যা গাড়ি বা বাইক রাখার জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। এতে পরিবহণের জন্য সমস্যা হতে পারে, বিশেষত যদি আপনার পরিবারে একাধিক গাড়ি থাকে।
৯. আইনি জটিলতা
ফ্ল্যাট কেনার আগে জমির মালিকানা এবং ডেভেলপমেন্টের অনুমোদন সঠিকভাবে যাচাই না করলে, পরে আইনি জটিলতা দেখা দিতে পারে। জমি সংক্রান্ত কোনো আইনি সমস্যা থাকলে তা ফ্ল্যাট মালিকের জন্য বিশাল ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
১০. ফ্ল্যাটের মূল্য কমে যাওয়া
বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে, যেমন অর্থনৈতিক মন্দা বা সেলুলার অঞ্চলে উন্নয়ন না হওয়া, ফ্ল্যাটের মূল্য কমে যেতে পারে। এর ফলে আপনার বিনিয়োগে ক্ষতি হতে পারে।
ফ্ল্যাট কেনার সময় এই অসুবিধাগুলোর কথা মাথায় রেখে সাবধানতা অবলম্বন করা এবং পরিকল্পনা করা জরুরি, যাতে পরবর্তীতে কোনো সমস্যা বা অস্বস্তি না হয়।