জ্বালানি তেল উৎপাদনে শীর্ষ দেশ: বিশ্ববাজারের নেতৃত্বে কারা?

জ্বালানি তেল উৎপাদনে শীর্ষ দেশ

জ্বালানি তেল বিশ্বের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। বিভিন্ন দেশের শিল্প, পরিবহন, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ নানা ক্ষেত্রে অপরিশোধিত তেলের চাহিদা অত্যন্ত বেশি। বিশ্বব্যাপী তেল উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় কিছু দেশ বিশেষভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। চলুন জেনে নিই, জ্বালানি তেল উৎপাদনে শীর্ষ দেশ কোনগুলো এবং তাদের তেল উৎপাদনের পরিমাণ কেমন।

১। যুক্তরাষ্ট্র

বর্তমানে জ্বালানি তেল উৎপাদনে শীর্ষ দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৩২ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন করেছে, যা বিশ্ব ইতিহাসে সর্বোচ্চ

যুক্তরাষ্ট্রের তেল উৎপাদনের ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যা ১৯শ শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছে।

প্রাথমিক আবিষ্কার

  • ১৮৫৯ সালে কর্ণেল এডউইন ড্রেক প্রথম যান্ত্রিক পদ্ধতিতে তেল উত্তোলন করেন, যা পেনসেলভেনিয়ার টিটুসভিলে ঘটে। এ ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তেল শিল্পের সূচনা করে।

২০শ শতকের উত্থান

  • ১৯০০ সালের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে তেল উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯১১ সালে, স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি ভেঙে যাওয়ার পর মার্কিন তেল শিল্পে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়।
  • ১৯২০ সালের মধ্যে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম তেল উৎপাদক দেশ হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়

  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যুক্তরাষ্ট্রের তেল উৎপাদন সামরিক প্রচেষ্টার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, দেশটি পুনরায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যায় এবং তেলের চাহিদা বৃদ্ধি পায়।

আধুনিক যুগ

  • ২০০০ সালের পর থেকে, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যেমন হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিং এবং হরিজেন্টাল ড্রিলিংয়ের কারণে শেল তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
  • ২০২০ সালে, যুক্তরাষ্ট্র দৈনিক ১ কোটি ৩১ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদনের রেকর্ড করে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে কিছুটা পতনের পর, ২০২৩ সালে দৈনিক ১ কোটি ৩২ লাখ ব্যারেল উৎপাদনে পৌঁছায়।

বর্তমান পরিস্থিতি

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব ইতিহাসে সর্বাধিক তেল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিত। দেশটি সৌদি আরব ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোর সমান পরিমাণ অপরিশোধিত তেল ও অন্যান্য জ্বালানি পণ্য রপ্তানি করছে ।যুক্তরাষ্ট্রের তেল উৎপাদনের ইতিহাস শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেশের অর্থনীতিতে একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করেছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে একটি শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করেছে।

২।রাশিয়া

রাশিয়ার তেল উৎপাদন ইতিহাস এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্ব জ্বালানি বাজারে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে।

তেল উৎপাদনের সূচনা

  • ১৯০০ সালের দিকে রাশিয়াতে তেল উৎপাদন শুরু হয়, এবং ১৯০১ সালে তারা প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক বাজারে তেল রপ্তানি করে।
  • সোভিয়েত যুগে, বিশেষ করে ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে, রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম তেল উৎপাদক দেশ হয়ে ওঠে।

আধুনিক সময়ের উৎপাদন

  • ২০০০ সালের পর রাশিয়া আবারও তেল উৎপাদনে শীর্ষে ফিরে আসে, এবং ২০২৩ সালে দৈনিক প্রায় ৯৪ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন করে।
  • তবে, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, রাশিয়া তাদের তেলের উৎপাদন প্রতিদিন পাঁচ লাখ ব্যারেল কমানোর ঘোষণা দেয়, যা বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও চ্যালেঞ্জ

  • ২০২২ সালে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর থেকে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা তাদের অর্থনীতি এবং তেল শিল্পকে প্রভাবিত করে।
  • যদিও নিষেধাজ্ঞার ফলে প্রাথমিকভাবে ক্ষতি হয়, রাশিয়া নতুন বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, বিশেষ করে ভারত ও চীনের সাথে।

ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি

রাশিয়া বর্তমানে তাদের তেল খাতের উন্নয়নে মনোযোগ দিচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে, তারা নতুন বাজার খুঁজছে এবং বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করছে।রাশিয়ার তেল উৎপাদনের ইতিহাস এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্ব জ্বালানি বাজারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

৩।সৌদি আরব

সৌদি আরবের তেল উৎপাদনের ইতিহাস দীর্ঘ এবং গুরুত্বপূর্ণ। এটি বিশ্ব তেল বাজারে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে এবং এর অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

তেল আবিষ্কার ও উৎপাদন শুরু

  • ১৯৪৮ সালে সৌদি আরবের পূর্ব প্রদেশে ঘওয়ার তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়।
  • ১৯৫১ সালে এই ক্ষেত্র থেকে তেল উৎপাদন শুরু হয়, যা সৌদি আরবের তেল শিল্পের সূচনা করে।

উত্পাদনের শিখর

  • ২০০৫ সালে ঘওয়ার ক্ষেত্রের উৎপাদন শীর্ষে পৌঁছেছিল, যদিও এর উৎপাদন পরিমাণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সৌদি আরামকো ২০০৮ সালে জানায় যে, তারা তাদের প্রমাণিত সঞ্চয়ের ৪৮% উৎপাদন করেছে।
  • ২০১০ সালের মধ্যে, ঘওয়ার ক্ষেত্র থেকে মোট ৬৫ বিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদিত হয়েছে।

ওপেক এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব

  • ১৯৬০ সালে সৌদি আরবসহ অন্যান্য তেল উৎপাদক দেশগুলো মিলে ওপেক (তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন) গঠন করে, যা তেলের দাম ও উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  • ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় সৌদি আরব তাদের তেলকে একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, যা বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি করে।

আধুনিক সময়

সৌদি আরব বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম তেল উৎপাদক দেশগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে দৈনিক প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদিত হয়। সৌদি আরামকো, দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি, বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটি।সৌদি আরবের তেলের ইতিহাস শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। দেশটি তার তেলের মাধ্যমে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে।

৪। কানাডা

কানাডার তেল উৎপাদনের ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং গতিশীল প্রক্রিয়া, যা দেশটির অর্থনীতিতে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।

প্রাথমিক উৎপাদন

  • কানাডায় তেল উৎপাদনের সূচনা ঘটে ১৮৫৮ সালে, যখন প্রথমবারের মতো তেল উত্তোলন শুরু হয়। তবে, ১৯শ শতকের শেষের দিকে এবং ২০শ শতকের শুরুতে উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।

তেল sands এবং আধুনিক প্রযুক্তি

  • ১৯৬০-এর দশকে কানাডার তেল sands খনিজ সম্পদ আবিষ্কৃত হয়, যা দেশের তেল উৎপাদনের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
  • ২০০০ সালের পর, হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিং এবং অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার তেল উৎপাদনে বিপ্লব ঘটায়, বিশেষ করে আলবার্টার তেল sands অঞ্চলে।

বর্তমান পরিস্থিতি

  • ২০২৩ সালে, কানাডার দৈনিক তেল উৎপাদন প্রায় ৫.৬৫ মিলিয়ন ব্যারেল ছিল, যা দেশের ইতিহাসে সর্বাধিক।
  • কানাডার তেলের প্রধান উৎস হলো তেল sands, যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৫৮% অবদান রাখে।

অর্থনৈতিক প্রভাব

  • কানাডা বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম তেল উৎপাদক দেশ এবং দেশের অর্থনীতিতে তেলের ভূমিকা অপরিসীম। এটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং সরকারি রাজস্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

কানাডার তেল উৎপাদনের ইতিহাস কেবল অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয় বরং পরিবেশগত ও সামাজিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। দেশটি এখন বিশ্বের অন্যতম প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী হিসেবে পরিচিত।

৫। ইরাক

ইরাকের তেল উৎপাদনের ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা দেশটির অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

প্রাথমিক উৎপাদন

  • ইরাকে তেল আবিষ্কৃত হয় ১৯২০-এর দশকে, যখন প্রথম তেল ক্ষেত্রগুলি খনন শুরু হয়। ১৯২৭ সালে, ইরাকের প্রথম তেল রপ্তানি শুরু হয়, যা দেশের অর্থনীতিতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

জাতীয়করণ

  • ১৯৭২ সালে, ইরাক সরকার দেশের তেল শিল্প জাতীয়করণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণ কমে যায় এবং সরকারী প্রতিষ্ঠান ইরাক পেট্রোলিয়াম কোম্পানি (IPC) প্রতিষ্ঠিত হয়।

ওপেক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি

  • ইরাক ১৯৬০ সালে ওপেক (তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন) গঠনে অংশগ্রহণ করে, যা তেলের দাম ও উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময়, ইরাক তেলকে একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এবং পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

যুদ্ধ এবং সংকট

  • ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময়, দেশের তেল উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, ১৯৯০ সালে কুয়েত আক্রমণের ফলে গাল্ফ যুদ্ধ শুরু হয়, যা আবারও ইরাকের তেল শিল্পকে প্রভাবিত করে।

আধুনিক সময়

  • ২০০৩ সালে ইরাকের ওপর মার্কিন আগ্রাসনের পর, দেশটির তেল শিল্প পুনর্গঠনের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা হয়। বর্তমানে, ইরাক বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম তেল উৎপাদক দেশ হিসেবে পরিচিত, যেখানে দৈনিক উৎপাদন প্রায় ৪.৫ মিলিয়ন ব্যারেলের কাছাকাছি।

ইরাকের তেল উৎপাদনের ইতিহাস শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেশের উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।

Join The Discussion

Compare listings

Compare
Open chat
Hello 👋
Can we help you?