জমি খারিজ করার পদ্ধতি: সম্পত্তির মালিকানা হালনাগাদ করার সহজ উপায়

জমি খারিজ করার পদ্ধতি

জমি খারিজ, অথবা নামজারি, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া যা জমির মালিকানা পরিবর্তন বা হালনাগাদ করার জন্য আবশ্যক। অনেক সময় জমি বিক্রি, হস্তান্তর বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্তি ঘটে এবং এই সময় সম্পত্তির মালিকানা সরকারী রেকর্ডে সংশোধন করতে হয়। জমি খারিজ একটি সহজ প্রক্রিয়া হলেও, এর মাধ্যমে জমির মালিকানা প্রমাণ করা যায়, যা পরবর্তীতে বিক্রি, ব্যাংক লোন কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়ায় সহায়ক হয়।

এই ব্লগ পোস্টে আমরা বিস্তারিত জানাবো জমি খারিজ করার পদ্ধতি সম্পর্কে।

 

জমি খারিজ কি?

জমি খারিজ হলো একটি সরকারি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জমির মালিকানা রেকর্ডে সংশোধন করা হয়। একটি জমি যদি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে হস্তান্তর হয়, তবে সেই ব্যক্তিকে রেকর্ডে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। এটি বিভিন্ন অঞ্চলে নামজারি, নাম কর্তন, কিংবা মিউটেশন নামেও পরিচিত।

 

জমি খারিজ কেন জরুরি?

জমি খারিজ করার মাধ্যমে আপনি আপনার জমির বৈধ মালিকানা নিশ্চিত করতে পারেন। এটি শুধুমাত্র জমির মালিকানা রেকর্ড হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া নয়, এটি সম্পত্তির বৈধতার প্রমাণও প্রদান করে। এটি আপনাকে জমির উপর কর পরিশোধ এবং অন্যান্য আইনগত কার্যক্রমে সহায়তা করবে।

এছাড়া, জমি খারিজ করা হলে আপনি ভবিষ্যতে জমির মালিকানা নিয়ে কোনো বিরোধে পড়বেন না এবং আপনি জমি বিক্রয় কিংবা অন্য কোনো লেনদেন করতে পারবেন।

জমি নামজারির ও জমি খারিজ বলতে কী বুজায়

জমি নামজারি ও জমি খারিজ আসলে একই অর্থ বহন করে এবং উভয়ই জমির মালিকানা রেকর্ড সংশোধন বা হালনাগাদকরণ প্রক্রিয়াকে বোঝায়। তবে ভাষাগত পার্থক্যের কারণে কখনও নামজারি এবং কখনও খারিজ শব্দ ব্যবহার করা হয়।

নামজারি ও খারিজের পার্থক্য কী?

নামজারি এবং খারিজ শব্দ দুটি ভিন্ন মনে হলেও বাস্তবে তারা একই প্রক্রিয়ার দুটি অংশ।

  • নামজারি:
    জমি বিক্রয়, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্তি, দান বা অন্য কোনো কারণে মালিকানা পরিবর্তন হলে সরকারি রেকর্ডে নতুন মালিকের নাম অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়াকে নামজারি বলা হয়।

  • খারিজ:
    জমির রেকর্ডে পুরনো মালিকের নাম অপসারণ করে নতুন মালিকের নাম যুক্ত করার প্রক্রিয়াকে খারিজ বলা হয়।

উদাহরণ:
একটি জমি বিক্রি হলে পুরনো মালিকের নাম রেকর্ড থেকে খারিজ করে নতুন মালিকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়, এটি নামজারি প্রক্রিয়ার অংশ।

কেন নামজারি বা খারিজ জরুরি?

  1. জমির মালিকানার বৈধতা নিশ্চিত করতে।
  2. জমি হস্তান্তর, বিক্রয়, ব্যাংক লোন, এবং রেকর্ড সংশোধনের জন্য।
  3. জমির ওপর কর (খাজনা) পরিশোধের জন্য।
  4. ভবিষ্যতে কোনো মালিকানা বিরোধ এড়াতে।
  5. দলিলের বৈধতা ও সরকারিভাবে রেকর্ড হালনাগাদ করতে।

জমি খারিজ কেন জরুরি?

জমি খারিজ বা নামজারি মূলত সরকারি রেকর্ডে জমির মালিকানা হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ কারণ জমির মালিকানা নিশ্চিত করার পাশাপাশি এটি আরও বিভিন্ন আইনি ও প্রশাসনিক কাজে সহায়ক হয়।

জমি খারিজের প্রয়োজনীয়তা:

১. মালিকানা প্রমাণের জন্য:

  • জমির নতুন মালিককে সরকারি রেকর্ডে বৈধ মালিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জমি খারিজ করতে হয়।
  • এটি জমি সংক্রান্ত যেকোনো বিরোধ বা জটিলতা এড়াতে সহায়তা করে।

২. জমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে:

  • জমি বিক্রয় বা হস্তান্তরের সময় খারিজ করা জরুরি। খারিজ না হলে ক্রেতা বা পরবর্তী মালিকের নামে খতিয়ান হালনাগাদ হবে না, ফলে ভবিষ্যতে আইনি সমস্যা দেখা দিতে পারে।

৩. কর পরিশোধে সুবিধা:

  • জমির খারিজ সম্পন্ন হলে মালিক নিজ নামে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতে পারেন।
  • জমি খারিজ না থাকলে কর পরিশোধ সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হয়।

৪. ব্যাংক ঋণ গ্রহণের জন্য:

  • জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক ঋণ নিতে হলে খারিজকৃত খতিয়ান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি ব্যাংকের কাছে জমির মালিকানা নিশ্চিত করার একমাত্র প্রামাণ্য নথি।

৫. উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে:

  • উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমির মালিকানা প্রমাণ এবং উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পত্তি বিভাজনের জন্য জমি খারিজ আবশ্যক।

৬. রেকর্ড হালনাগাদ ও রক্ষণাবেক্ষণ:

  • জমি খারিজ করলে ভূমির রেকর্ড হালনাগাদ হয়, যা ভবিষ্যতে জমির মালিকানা সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য সঠিকভাবে যাচাই করতে সাহায্য করে।

৭. জমি সংক্রান্ত বিরোধ প্রতিরোধে:

  • জমি খারিজের মাধ্যমে নতুন মালিকের নাম সরকারি রেকর্ডে যুক্ত হলে পুরোনো মালিক আর সেই জমি পুনরায় বিক্রয় করতে পারেন না। ফলে প্রতারণার ঝুঁকি কমে যায়।

উদাহরণস্বরূপ:

ধরুন, আপনি একটি জমি কিনেছেন কিন্তু নামজারি করেননি। পরবর্তী সময়ে বিক্রেতা সেই একই জমি অন্য কারো কাছে বিক্রি করে দিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ দেখা দিতে পারে। কিন্তু জমি খারিজ করার মাধ্যমে আপনি সরকারি রেকর্ডে বৈধ মালিক হিসেবে যুক্ত থাকবেন, ফলে এ ধরনের সমস্যা এড়ানো সম্ভব।

সারসংক্ষেপ:
জমি খারিজ জরুরি কারণ এটি জমির মালিকানা নিশ্চিত করে, আইনি সুরক্ষা প্রদান করে এবং ভবিষ্যতের যেকোনো ধরনের জটিলতা ও প্রতারণা থেকে রক্ষা করে।

জমি খারিজ করার পদ্ধতি

জমি খারিজ করা বলতে সরকারি রেকর্ডে জমির মালিকানা হালনাগাদ করা বোঝায়। বর্তমানে অনলাইনে এবং অফলাইনে জমি খারিজ করার প্রক্রিয়া অনেক সহজ হয়েছে। এখানে ধাপে ধাপে জমি খারিজের পদ্ধতি তুলে ধরা হলো:

১. প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করুন:

জমি খারিজ করার জন্য প্রথমে নিম্নোক্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে হবে:

  1. মূল দলিল (সাফ-কবলা, হেবা, বণ্টননামা ইত্যাদি)।
  2. বায়া দলিল (যদি জমিটি ক্রয়সূত্রে পাওয়া হয়ে থাকে)।
  3. সর্বশেষ রেকর্ডকৃত খতিয়ান (BRS, RS, BS ইত্যাদি)।
  4. খাজনা পরিশোধের দাখিলা (ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের রশিদ)।
  5. জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি (মালিক ও আবেদনকারীর)।
  6. পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি
  7. মোবাইল নম্বর (সচল ও ওটিপি গ্রহণের জন্য)।
  8. উত্তরাধিকার সনদ (উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমির ক্ষেত্রে)।

২. অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়া:

আপনি চাইলে ঘরে বসেই অনলাইনে জমি খারিজ আবেদন করতে পারেন।

  1. ভিজিট করুন:

  2. নিবন্ধন করুন:

    • ওয়েবসাইটে গিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করুন এবং প্রয়োজনীয় তথ্য দিন।
  3. আবেদন ফর্ম পূরণ করুন:

    • সম্পত্তির তথ্য (মৌজা, দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর, জমির পরিমাণ ইত্যাদি) দিন।
    • আপনার তথ্য (নাম, আইডি নম্বর, ঠিকানা) সঠিকভাবে দিন।
  4. প্রয়োজনীয় নথি আপলোড করুন:

    • প্রয়োজনীয় কাগজপত্র স্ক্যান করে নির্ধারিত স্থানে আপলোড করতে হবে।
  5. ফি পরিশোধ করুন:

    • জমি খারিজের জন্য নির্ধারিত ফি (প্রায় ১১৭০ টাকা) অনলাইনে পরিশোধ করতে হবে।
    • পেমেন্ট করা যাবে বিকাশ, রকেট, নগদ বা ব্যাংকের মাধ্যমে।
  6. আবেদন জমা দিন:

    • আবেদন জমা দিলে একটি ট্র্যাকিং নম্বর দেওয়া হবে। এটি দিয়ে আপনি আবেদন স্ট্যাটাস চেক করতে পারবেন।

 

৩. অফিসে সরাসরি আবেদন পদ্ধতি:

যদি আপনি অনলাইনে আবেদন করতে না পারেন, তবে সংশ্লিষ্ট উপজেলা ভূমি অফিস বা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে সরাসরি আবেদন করতে পারবেন।

  1. সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিন।
  2. একটি আবেদন ফরম পূরণ করুন।
  3. আবেদন জমা দেওয়ার পর অফিস থেকে রসিদ সংগ্রহ করুন।
  4. অফিসে আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে রিপোর্ট প্রস্তুত করা হবে।

৪. যাচাই-বাছাই ও শুনানি:

  1. জমির মালিকানা ও নথিপত্র যাচাই করার জন্য ভূমি অফিস আবেদন পর্যালোচনা করবে।
  2. প্রয়োজনে সহকারী কমিশনার (ভূমি) শুনানি করবেন এবং সকল পক্ষের কাগজপত্র মিলিয়ে দেখবেন।

৫. নামজারি অনুমোদন:

যাচাই-বাছাই শেষে জমি খারিজ অনুমোদন করা হয় এবং নতুন খতিয়ান ইস্যু করা হয়।

  1. অনুমোদন হলে SMS এর মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়।
  2. অনলাইনে নামজারি সার্টিফিকেট ডাউনলোড করা যায়।
  3. ভূমি অফিস থেকেও সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা যাবে।

৬. নামজারি খতিয়ান সংগ্রহ করুন:

নামজারি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে আপনার নামে নতুন খতিয়ান সংগ্রহ করতে পারবেন।

জমি খারিজের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করে অনলাইনে বা সরাসরি ভূমি অফিসে আবেদন করতে হয়। খারিজ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে নতুন মালিকের নামে খতিয়ান ইস্যু হয়, যা জমির বৈধ মালিকানা প্রমাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নথি।

নামজারি/খারিজের সময়সীমা

নামজারি বা খারিজ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সাধারণত ৩০ কার্যদিবস সময় লাগে, তবে এটি নির্ভর করে জমির অবস্থান এবং আবেদন পত্রের পূর্ণতা অনুযায়ী।

নামজারি/খারিজের ফি

নামজারি বা খারিজের জন্য সাধারণত ১১৭০ টাকা ফি প্রযোজ্য (২০২৪ সালে)।

জমি খারিজের প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি সম্পত্তির মালিকানা প্রমাণে সহায়ক। এটি আপনাকে জমির বৈধ মালিক হিসেবে নিশ্চিত করে এবং ভবিষ্যতে জমি বিক্রি বা অন্যান্য আইনি কার্যক্রমে সহায়তা করে। তাই জমির খারিজ প্রক্রিয়া যথাযথভাবে সম্পন্ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Join The Discussion

Compare listings

Compare
Search
Price Range From To
Open chat
Hello 👋
Can we help you?