ইট : নির্মাণশিল্পের একটি অপরিহার্য উপাদান

ইট

ইট হল একটি শক্ত এবং টেকসই নির্মাণ উপাদান, যা প্রধানত মাটি, বালি এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ মিশ্রিত করে প্রস্তুত করা হয়। এটি বিভিন্ন আকার ও ধরনের হয়ে থাকে এবং বহুমুখী ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত। নির্মাণ কাজের ভিত্তি, দেয়াল, কলাম, সজ্জা এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে ইটের ব্যবহার ব্যাপক।

ইটের সাধারণ উপাদান

ইট তৈরিতে প্রধানত নিম্নলিখিত উপাদানগুলো ব্যবহৃত হয়:

  1. মাটি: ইট তৈরির মূল উপাদান, যা সাধারণত লাল বা হলুদ রঙের হয়।
  2. বালি: ইটের কাঠামো মজবুত করতে বালির মিশ্রণ প্রয়োজন।
  3. পানি: মাটি ও বালির মিশ্রণ তৈরি করতে পানি ব্যবহার করা হয়।
  4. খনিজ পদার্থ: কিছু ইটের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত খনিজ পদার্থ মিশ্রিত করা হয়, যা ইটের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বাড়ায়।

তবে উৎকৃষ্ট মানের ইট তৈরিতে নিম্নলিখিত উপাদানগুলোর সুনির্দিষ্ট অনুপাতে ব্যাবহার করে লাগে যা ইটের গুণগত মান বজায় রাখতে সাহায্য করে।

  1. সিলিকা (SiO₂): ৫৫%
  2. অ্যালুমিনা (Al₂O₃): ৩০%
  3. আয়রন অক্সাইড (Fe₂O₃): ৮%
  4. ম্যাগনেশিয়া (MgO): ৫%
  5. লাইম (CaO): ১%
  6. জৈব পদার্থ: ১%

এই উপাদানগুলোর সঠিক অনুপাত বজায় রেখে ইট প্রস্তুত করলে তা শক্ত, টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়।

ইটের আদর্শ আকার (Standard Size)

১. মসলাছাড়া ইটের সাইজ:

  • দৈর্ঘ্য: ৯.৫” (242 মিমি)
  • প্রস্থ: ৪.৫” (114 মিমি)
  • উচ্চতা: ২.৭৫” (70 মিমি)
  • এটি সাধারণত PWD সিডিউল অনুযায়ী ব্যবহৃত হয়।

২. মসলা সহ ইটের সাইজ:

  • দৈর্ঘ্য: ১০” (254 মিমি)
  • প্রস্থ: ৫” (127 মিমি)
  • উচ্চতা: ৩” (76 মিমি)

৩. মেট্রিক ইটের সাইজ (উন্নত মানের জন্য ব্যবহৃত):

  • দৈর্ঘ্য: 190 মিমি
  • প্রস্থ: 90 মিমি
  • উচ্চতা: 90 মিমি

অথবা

  • দৈর্ঘ্য: 200 মিমি
  • প্রস্থ: 100 মিমি
  • উচ্চতা: 100 মিমি

এই আকারগুলো দেশে  ভেদে  ও নির্দিষ্ট কাঠামো প্রকল্পের জন্য বিভিন্ন ররকমের হয়ে থাকে।

ইটের বৈশিষ্ট্য: নির্মাণে ইটের গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলী

ইট একটি বহুল ব্যবহৃত নির্মাণ উপাদান, যা ভবনের গুণগত মান এবং স্থায়িত্বে বড় ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন প্রকারের ইট নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে ব্যবহৃত হয় এবং বৈশিষ্ট্যের ওপর ইট এর দাম ঠিক করা হয়। চলুন ইটের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো জেনে নিই:

১. শক্তি (Strength)

ইটের শক্তি তার লোড বহন ক্ষমতা দ্বারা নির্ধারিত হয়।

  • ভালো মানের ইট প্রতি বর্গসেন্টিমিটারে ১০৫ কেজি বা তার বেশি চাপ সহ্য করতে পারে।
  • এটি নির্মাণকাজের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।

২. ওজন (Weight)

ইটের ওজন তার উপাদান এবং গুণগত মানের ওপর নির্ভরশীল।

  • সাধারণত ইট হালকা থেকে মাঝারি ওজনের হয়।
  • এটি ভবনের কাঠামোতে ভারসাম্য রক্ষা করে।

৩. পানি শোষণ ক্ষমতা (Water Absorption)

ইটের পানি শোষণ ক্ষমতা ১৫% এর কম হলে তা ভালো মানের বলে বিবেচিত হয়।

  • নিম্নমানের ইট বেশি পানি শোষণ করে, যা ভবনের স্থায়িত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

৪. তাপ নিরোধক (Thermal Insulation)

ইট তাপ নিরোধক হিসেবে কাজ করে।

  • এটি গরম বা ঠান্ডা আবহাওয়ায় ভবনের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
  • বিশেষ করে ফ্লাই অ্যাশ ইট এবং ক্যালসিয়াম সিলিকেট ইট তাপ নিরোধকের ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর।

৫. শব্দ নিরোধক (Sound Insulation)

ইটের ঘনত্ব এবং গঠন শব্দ নিরোধক বৈশিষ্ট্য প্রদান করে।

  • এটি ভবনে আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করে।

৬. আগুন প্রতিরোধ ক্ষমতা (Fire Resistance)

ইটের আগুন প্রতিরোধ ক্ষমতা উচ্চ।

  • বিশেষ করে ফায়ারব্রিক ৩০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপ সহ্য করতে পারে।
  • এটি ভবনের নিরাপত্তা বাড়ায়।

৭. রঙ এবং আকৃতি (Color and Shape)

ভালো ইটের রঙ গাঢ় লাল বা লালচে বাদামি হয়।

  • আকৃতি এবং আকার সমান হলে ইট সহজে গাঁথা যায়।
  • ভালো ইটের ধার বা কোণগুলো তীক্ষ্ণ এবং মসৃণ হয়।

৮. স্থায়িত্ব (Durability)

ভালো ইট দীর্ঘস্থায়ী এবং ক্ষয়-প্রতিরোধী।

  • এটি সময়ের সঙ্গে ফাটল ধরে না বা ভাঙে না।

৯. কম পরিমাণে ফাটল (Low Porosity)

ইটের পোরোসিটি কম হলে তা পানি এবং আর্দ্রতা প্রতিরোধী হয়।

  • কম পোরোসিটি ইট ভবনের ভিত্তি ও দেয়ালে টেকসই গুণ বজায় রাখে।

১০. বহুমুখী ব্যবহার (Versatility)

ইট বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়:

  • লোড-বেয়ারিং দেয়াল, বেসমেন্ট, কলাম এবং সজ্জা।
  • ইকো-ব্রিক এবং কংক্রিট ব্রিক পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়।


ইটের বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে তার উৎপাদন প্রক্রিয়া, উপাদান এবং ব্যবহারের ধরন অনুযায়ী। সঠিক ইট নির্বাচন ভবনের গুণগত মান এবং দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করে। তাই নির্মাণ কাজের জন্য ইট নির্বাচন করার সময় অবশ্যই এর বৈশিষ্ট্য যাচাই করা উচিত।

১ম শ্রেণীর ইট
মিঠা ইট
পিকেট ইট
ইট
ইট
ইট

ইটের প্রকারভেদ

নির্মাণশিল্পে ব্যবহৃত ইট বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। প্রয়োজন এবং গুণগত মান অনুযায়ী ইটকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। নিচে ইটের প্রধান প্রকারভেদগুলো তুলে ধরা হলোঃ

১. পোড়ানো ইট (Burnt Bricks):

এই ইট উচ্চ তাপে পোড়ানো হয় এবং এটি নির্মাণশিল্পের জন্য সবচেয়ে প্রচলিত ইট। পোড়ানো ইটকে আবার চারটি ভাগে ভাগ করা যায়ঃ

  • ১ম শ্রেণীর ইট: উচ্চ মানসম্পন্ন, মসৃণ, আকার ও রঙে সমান। স্থায়ী কাঠামোতে ব্যবহৃত হয়।
  • ২য় শ্রেণীর ইট: কিছুটা ত্রুটি থাকতে পারে, তবে কাঠামো নির্মাণে ব্যবহারের উপযোগী।
  • ৩য় শ্রেণীর ইট: মান কম, অস্থায়ী কাঠামো বা বাগানের প্রাচীর তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
  • ৪র্থ শ্রেণীর ইট: অতিরিক্ত পোড়ানো বা ভেঙে যাওয়া, সাধারণত রাস্তা বা ভরাট কাজে ব্যবহৃত হয়।

১ম শ্রেণীর ইট

  • সাইজ নিখুঁত ও দেখতে গাঢ় লাল।
  • সমানভাবে পোড়ানো থাকে।
  • দুটো ইট পরস্পর আঘাত করলে পরিষ্কার টন টন শব্দ হয়।
  • ইটের মধ্যে কোনো চিড় বা ফাঁক থাকে না।
  • ধার ও কোনগুলো সমান এবং মসৃণ।
  • ৪ ফুট উচ্চতা থেকে ফেলে দিলে সহজে ভাঙে না।
  • পানি শোষণ ক্ষমতা: ১৫% এর বেশি নয় (Lab Test)।
  • লোড বহন ক্ষমতা: ১০৫ কেজি/সেমি² (Lab Test)।

২য় শ্রেণীর ইট (পিকেট স্পেশাল)

  • রং এবং শক্তির দিক থেকে ১ম শ্রেণীর মতো।
  • আকার এবং আকৃতিতে কিছুটা অসমান।
  • তলা অমসৃণ থাকে।
  • পর্যাপ্ত পোড়ানো হয় না, এবং ফাটল দেখা যায়।
  • ইট আঘাত করলে ঠন ঠন শব্দ হয়।
  • পানি শোষণ ক্ষমতা: ১৫% এর বেশি।

৩য় শ্রেণীর ইট (পিকেট)

  • পর্যাপ্ত পোড়ানো হয় না।
  • গুণগত মান নিম্নমানের।
  • আঘাত করলে কিছুটা ঠন ঠন শব্দ হয়।
  • পানি শোষণ ক্ষমতা: ২৫% এর বেশি।

৪র্থ শ্রেণীর ইট (মিঠা)

  • খুবই কম পোড়ানো থাকে।
  • গুণগত মান একেবারেই নিম্ন।
  • সহজেই ভেঙে যায়।
  • আঘাতে কিছুটা ঠন ঠন শব্দ হয়।
  • পানি শোষণ ক্ষমতা: ২৫% এর বেশি।

২. সান-ড্রাইড ইট (Sun-dried Bricks):

কাঁচা ইটকে রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হয়। এগুলো সাধারণত অস্থায়ী কাঠামো তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। শক্তিশালী নয় এবং পানি সহ্য করতে পারে না।

৩. ফ্লাই অ্যাশ ইট (Fly Ash Bricks):

এই ইট ফ্লাই অ্যাশ, চুন, এবং জল দিয়ে তৈরি। এটি হালকা, শক্ত এবং তাপ সহনশীল। পরিবেশবান্ধব এবং স্থায়ী নির্মাণে ব্যবহৃত হয়।

৪. কংক্রিট ইট (Concrete Bricks):

সিমেন্ট, বালি এবং পানি মিশিয়ে তৈরি হয়। অত্যন্ত শক্তিশালী এবং টেকসই। সাধারণত দেয়াল এবং পেভমেন্ট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

৫. ইঞ্জিনিয়ারিং ইট (Engineering Bricks):

উচ্চ মানের মাটি দিয়ে তৈরি, যা অত্যন্ত শক্তিশালী, ঘন এবং পানি প্রতিরোধী। সাধারণত বেসমেন্ট বা ভারী লোড বহনের কাজে ব্যবহৃত হয়।

৬. আগুন প্রতিরোধী ইট (Fire Bricks):

এগুলো বিশেষভাবে আগুন সহনশীল। ফায়ারপ্লেস, চিমনি বা শিল্প চুল্লিতে ব্যবহৃত হয়।

৭. ক্যালসিয়াম সিলিকেট ইট (Calcium Silicate Bricks):

সিলিকা বালি এবং চুন দিয়ে তৈরি। এগুলো হালকা এবং তাপ নিরোধক। বহুতল ভবন ও ঠান্ডা এলাকায় ব্যবহৃত হয়।

৮. ঝামা ইট (Jhama Bricks):

অতিরিক্ত পোড়ানোর ফলে কালো রঙ ধারণ করে। সাধারণত রাস্তা নির্মাণ বা ভরাট কাজে ব্যবহৃত হয়।

৫ম শ্রেণীর ইট (ঝামা)

  • অতিরিক্ত চাপ দিয়ে পোড়ানো হয়।
  • কালো ও ফাঁপা হয়ে থাকে।
  • শরীরে ফাটা বা টিউমারের মতো ফুলে ওঠা দাগ থাকে।
  • দেখতে অত্যন্ত বিশ্রী।

৯. ইকো ইট (Eco Bricks):

পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ যেমন প্লাস্টিক বোতল, কাগজ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি। অস্থায়ী কাঠামো বা সজ্জায় ব্যবহৃত হয়।

 

ভালো ইট চেনার উপায়

ইট একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ সামগ্রী, যা ভবনের স্থায়িত্ব ও গুণগত মান নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে। ভালো ইট চেনার কয়েকটি সহজ এবং কার্যকর উপায় নিচে তুলে ধরা হলো:

১. রঙ এবং গুণগত মান

ভালো ইট সাধারণত গাঢ় লাল বা লালচে বাদামি হয়। এটি সমানভাবে পোড়ানো হলে রঙ সুষম থাকে। কালচে বা ফ্যাকাশে রঙের ইট সাধারণত নিম্নমানের।

২. আকার এবং আকৃতি

  • ইটের আকার হবে সমান এবং নিয়মিত আকৃতির (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা সমানুপাতিক)।
  • কোনাগুলো হবে মসৃণ এবং ধারালো।

৩. শব্দ পরীক্ষা

দুটি ইট পরস্পরের সাথে আঘাত করলে পরিষ্কার এবং ধাতব ধরনের টন টন শব্দ হবে। শব্দ যদি ঠন ঠন হয়, তাহলে ইট নিম্নমানের।

৪. ভাঙার পরীক্ষা

  • ৪ ফুট উচ্চতা থেকে মাটিতে ফেলে দিলে ইট সহজে ভাঙবে না।
  • ইটের গঠন দৃঢ় হলে এটি ভালো ইটের পরিচায়ক।

৫. পানি শোষণ পরীক্ষা

  • ইট ২৪ ঘণ্টা পানিতে ডুবিয়ে রাখুন।
  • বের করার পর যদি ইট নিজের ওজনের ১৫% এর বেশি পানি শোষণ করে, তবে এটি নিম্নমানের।
  • ভালো ইটের পানি শোষণ ক্ষমতা ১৫% এর কম হয়।

৬. লোড বহন ক্ষমতা

ভালো ইট প্রতি বর্গসেন্টিমিটারে ১০৫ কেজি বা তার বেশি চাপ সহ্য করতে সক্ষম।

৭. পোড়ানোর গুণগত মান

সমানভাবে পোড়ানো ইটের রং হবে অভিন্ন এবং গঠন হবে শক্ত। কম পোড়ানো বা বেশি পোড়ানো ইট সাধারণত ভাঙা বা ফাঁপা হতে পারে।

৮. ভাঙার পর গঠন

ইট ভাঙলে এর ভেতরের গঠন যদি একজাতীয় হয় এবং কোনো ফাটল না থাকে, তবে তা ভালো মানের ইট।

৯. ব্যবহার উপযোগিতা অনুযায়ী পরীক্ষা

  • লোড-বেয়ারিং প্রজেক্টের জন্য: ১ম শ্রেণীর ইট বেছে নিন।
  • অস্থায়ী কাঠামোর জন্য: ৩য় বা ৪র্থ শ্রেণীর ইট ব্যবহার করতে পারেন।

একটি ভালো ইট চেনার উপায় হল এর রং, গঠন, শক্তি এবং নির্দিষ্ট পরীক্ষার ফলাফল। নির্মাণকাজের দীর্ঘস্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে অবশ্যই ভালো মানের ইট নির্বাচন করুন

Join The Discussion

Compare listings

Compare
Open chat
Hello 👋
Can we help you?