আমরা যে পৃথিবীকে স্থির ও অনড় ভাবি, বাস্তবে তা কখনোই নিশ্চল নয়। ভূমিকম্প কেন হয় – এই প্রশ্নটি আমাদের বহুকাল ধরে ভাবিয়েছে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ভূমিকম্প হলো ভূ-পৃষ্ঠের হঠাৎ ও ক্ষণস্থায়ী কম্পন, যা কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই প্রাকৃতিক ঘটনা যতটা ভয়ঙ্কর, তার কারণগুলি ততটাই বৈজ্ঞানিক ও জটিল। আসুন জেনে নেই, আসলে ভূমিকম্প কেন হয়।
ভূমিকম্পের প্রধান কারণসমূহ
১. টেকটোনিক প্লেট ও শিলাচ্যুতি (ফল্ট)
পৃথিবীর উপরের স্তর, যাকে আমরা ভূত্বক বলি, তা অনেকগুলো বিশাল টেকটোনিক প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত। এই প্লেটগুলো ভূ-অভ্যন্তরে থাকা তরল পদার্থের উপর ভাসমান অবস্থায় থাকে এবং অত্যন্ত ধীর গতিতে চলাচল করে। যখন দুটি প্লেট পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন তাদের মধ্যে প্রচণ্ড ঘর্ষণ সৃষ্টি হয়। এই ঘর্ষণের ফলে শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে এবং একসময় তা হঠাৎ মুক্তি পায়, যা ভূমিকম্প হিসেবে প্রকাশ পায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পৃথিবীর ৯০% এরও বেশি ভূমিকম্প এই টেকটোনিক প্লেটের চলাচলের কারণে ঘটে থাকে। এই ধরনের ভূমিকম্পকে “টেকটোনিক ভূমিকম্প” বলা হয়।
২. আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ
আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ বা লাভা উৎক্ষেপণের সময় ভূ-অভ্যন্তরে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়। এই চাপের কারণে ভূত্বকের নিচে শক্তিশালী স্থানচ্যুতি ঘটে, যা ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। এ ধরনের ভূমিকম্পকে “আগ্নেয়গিরিজ ভূমিকম্প” বলা হয়।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, যেখানে সক্রিয় আগ্নেয়গিরির সংখ্যা বেশি, সেখানে এ ধরনের ভূমিকম্প নিয়মিত ঘটে থাকে। জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং আলাস্কা এর উদাহরণ।
৩. ভূপাত বা ভূধস
পাহাড়-পর্বত থেকে বড় শিলাখণ্ড হঠাৎ ভূপৃষ্ঠে ধসে পড়লে তা ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। যখন বিশাল শিলাখণ্ড বা পাহাড়ের অংশ ধসে পড়ে, তখন তা পৃথিবীর ভূত্বকে শক্তিশালী কম্পন সৃষ্টি করে। এই ধরনের ভূমিকম্প সাধারণত স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে এবং বড় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে না।
৪. ভূ-অভ্যন্তরে বাষ্পের চাপ
ভূ-অভ্যন্তরে পানি প্রবেশ করে যখন উচ্চ তাপমাত্রার কারণে বাষ্পে পরিণত হয়, তখন সেই বাষ্পের চাপ বৃদ্ধি পায়। এই বর্ধিত চাপ ভূত্বকের নিচে ধাক্কা দেয়, যার ফলে ভূমিকম্প হতে পারে। এই প্রক্রিয়া বিশেষভাবে থার্মাল স্প্রিং এবং গয়সারের কাছাকাছি অঞ্চলে দেখা যায়।
৫. হিমবাহের প্রভাব
বিশাল হিমবাহ বা বরফের পাহাড় যখন হঠাৎ করে নিচে পড়ে যায়, তখন তাও ভূপৃষ্ঠে কম্পন সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষত আর্কটিক এবং অ্যান্টার্কটিকার মতো অঞ্চলে, যেখানে বিশাল হিমবাহ রয়েছে, সেখানে এই ধরনের ভূমিকম্প দেখা যায়।
মানবসৃষ্ট কারণে ভূমিকম্প
প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও, মানবসৃষ্ট নানা কার্যকলাপ ভূমিকম্পের জন্ম দিতে পারে:
১. খনিতে বিস্ফোরণ
খনিতে যখন বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, তখন তা ভূপৃষ্ঠে কম্পন সৃষ্টি করে। বিশেষ করে কয়লা ও ধাতব খনিতে বড় পরিমাণে বিস্ফোরক পদার্থ ব্যবহার করা হয়, যা ছোট আকারের ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে।
২. বড় বাঁধ নির্মাণ
বড় জলাধারের নিচে জমা হওয়া বিপুল পরিমাণ পানির চাপ মাটির নিচের চাপ বাড়ায়, যা ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। চীনের থ্রি গর্জেস ড্যাম এবং ভারতের কোয়না ড্যামের মতো বৃহৎ বাঁধগুলির আশেপাশে এ ধরনের ভূমিকম্প দেখা গেছে।
৩. ভূগর্ভস্থ নিউক্লিয়ার পরীক্ষা
ভূগর্ভে নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরণ করা হলে তা প্রচণ্ড শক্তি উৎপন্ন করে, যা ভূমিকম্পের মতো কম্পন সৃষ্টি করে। শীতল যুদ্ধের সময় এমন অনেক পরীক্ষা করা হয়েছিল যা ভূকম্পন সৃষ্টি করেছিল।
৪. ফ্র্যাকিং বা হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিং
তেল ও গ্যাস উত্তোলনের জন্য ব্যবহৃত এই প্রযুক্তিতে উচ্চ চাপে পানি, বালি ও রাসায়নিকের মিশ্রণ ভূগর্ভে প্রবেশ করানো হয়। এই প্রক্রিয়া ভূগর্ভে চাপ বৃদ্ধি করে এবং ফলস্বরূপ ভূমিকম্প হতে পারে।
ভূমিকম্পের তীব্রতা মাপার পদ্ধতি
ভূমিকম্পের তীব্রতা দুই ভাবে মাপা হয়:
- রিখটার স্কেল: এটি ভূমিকম্পের মাগনিটিউড বা আকার পরিমাপ করে, যা মূলত ভূমিকম্পের সময় নির্গত শক্তির পরিমাণ নির্দেশ করে। এটি লগারিদমিক স্কেল, যার অর্থ প্রতি এক ইউনিট বৃদ্ধি শক্তির ১০ গুণ বৃদ্ধি নির্দেশ করে।
- মার্কালি স্কেল: এটি ভূমিকম্পের তীব্রতা পরিমাপ করে, যা ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি এবং মানুষের অনুভূতির উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। এটি I থেকে XII পর্যন্ত বিস্তৃত।
ভূমিকম্প থেকে সুরক্ষার উপায়
ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়। তবে কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে ক্ষয়ক্ষতি কমানো যেতে পারে:
- ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ: আধুনিক প্রকৌশল জ্ঞান ব্যবহার করে ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন তৈরি করা সম্ভব।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: ভূমিকম্প সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ালে লোকজন দ্রুত ও সঠিকভাবে সাড়া দিতে পারে।
- ভূমিকম্প ড্রিল: নিয়মিত ভূমিকম্প মহড়া আয়োজন করে মানুষকে প্রস্তুত রাখা যায়।
- পূর্বাভাস ব্যবস্থা: যদিও ভূমিকম্পের সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া এখনও কঠিন, তবে কিছু অঞ্চলে প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা চালু আছে।
ভূমিকম্প কেন হয় – এই জটিল প্রশ্নের উত্তর আমরা এখন বুঝতে পারি। ভূমিকম্প মূলত ভূ-অভ্যন্তরে সঞ্চিত শক্তির হঠাৎ মুক্তির ফলাফল। প্রাকৃতিক কারণ যেমন টেকটোনিক প্লেটের চলাচল, আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ থেকে শুরু করে মানবসৃষ্ট কারণ যেমন ভূগর্ভস্থ বিস্ফোরণ, বড় বাঁধ নির্মাণ – সবই ভূমিকম্পের জন্ম দিতে পারে।
ভূমিকম্প প্রকৃতির এক রহস্যময় শক্তির প্রকাশ, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে পৃথিবী সবসময় গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে আমরা ভূমিকম্প সম্পর্কে আরও জানতে পারছি এবং এর বিরুদ্ধে লড়াই করার নতুন উপায় খুঁজে পাচ্ছি।