ভূমিকম্প কি? কারণ, প্রভাব ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা

ভূমিকম্প কি

ভূমিকম্প কি? এটি পৃথিবীর অভ্যন্তরে সংঘটিত এক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যেখানে ভূ-ত্বকের নিচে সঞ্চিত শক্তির মুক্তি ঘটে এবং এর ফলে ভূপৃষ্ঠ কম্পিত হয়। এই কম্পন শক্তিশালী তরঙ্গ হিসেবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, যা পৃথিবীর উপরিভাগে নাড়া দেয়। ভূমিকম্প পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলেই হতে পারে, তবে কিছু এলাকা বিশেষত ভূমিকম্প প্রবণ বলে পরিচিত।

ভূমিকম্পের কারণ

ভূমিকম্প সাধারণত নিম্নলিখিত কারণে সংঘটিত হয়:

১. টেকটনিক প্লেট সঞ্চালন

পৃথিবীর উপরিভাগ বিভিন্ন টেকটনিক প্লেট দিয়ে গঠিত, যেগুলো ধীরে ধীরে চলাচল করে। যখন এই প্লেটগুলো একে অপরের সাথে ঘর্ষণে আসে বা ধাক্কা খায়, তখন প্রচুর পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হয়। এই শক্তি যখন হঠাৎ মুক্তি পায়, তখন ভূমিকম্প সংঘঠিত হয়। এটি ভূমিকম্পের সবচেয়ে সাধারণ কারণ।

২. আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপ

আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বা এর আশেপাশের এলাকায় ম্যাগমার সঞ্চালন ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। যখন ম্যাগমা ভূ-পৃষ্ঠে উঠে আসে, তখন পথে বিভিন্ন শিলাস্তর ভেঙ্গে যায় এবং কম্পন সৃষ্টি করে।

৩. মানবসৃষ্ট কারণ

কিছু ভূমিকম্প মানুষের কার্যকলাপের কারণেও হতে পারে, যেমন:

  • বড় জলাধার বা বাঁধ নির্মাণ
  • খনিজ সম্পদ উত্তোলন
  • ভূগর্ভস্থ পরমাণু পরীক্ষা
  • হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিং বা ফ্র্যাকিং

ভূমিকম্পের পরিমাপ

ভূমিকম্পের শক্তি পরিমাপের জন্য দুটি প্রধান স্কেল ব্যবহার করা হয়:

  • রিখটার স্কেল: এটি ভূমিকম্পের তীব্রতা পরিমাপ করে। এটি একটি লগারিদমিক স্কেল, যার অর্থ হল প্রতি পয়েন্টে বৃদ্ধির সাথে শক্তি ১০ গুণ বাড়ে।
  • মার্কালি স্কেল: এটি ভূমিকম্পের প্রভাব বা ক্ষতির পরিমাণ পরিমাপ করে।

ভূমিকম্পের প্রভাব

১. ভৌত ক্ষতি

ভূমিকম্প বিভিন্ন ধরনের ভৌত ক্ষতি সাধন করতে পারে:

  • ভবন ও অবকাঠামো ধ্বংস
  • রাস্তা ও সেতু ক্ষতিগ্রস্ত
  • বিদ্যুৎ, পানি এবং গ্যাস লাইন বিচ্ছিন্ন

২. জীবন হানি

শক্তিশালী ভূমিকম্পে বহু মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। মৃত্যু সাধারণত ভবন ধসের কারণে হয়, ভূমিকম্প নিজে থেকে নয়।

৩. অর্থনৈতিক প্রভাব

ভূমিকম্পের পরে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ হতে পারে। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, পর্যটন প্রভাবিত হতে পারে, এবং পুনর্নির্মাণে বিপুল অর্থ ব্যয় হতে পারে।

৪. অনুষঙ্গ দুর্যোগ

ভূমিকম্প প্রায়ই অন্যান্য দুর্যোগেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়:

  • সুনামি: সমুদ্রের নীচে ভূমিকম্প হলে বিশাল জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হতে পারে
  • ভূমিধস: পাহাড়ি এলাকায় ভূমিকম্প ভূমিধস ঘটাতে পারে
  • আগুন: গ্যাস লাইন ফেটে গিয়ে আগুন লাগতে পারে

ভূমিকম্প থেকে সুরক্ষা

ভূমিকম্পের আগে:

১. আপৎকালীন পরিকল্পনা করুন: পরিবারের সাথে আলোচনা করে একটি পরিকল্পনা তৈরি করুন যেখানে বিপদকালীন সময়ে কী করতে হবে এবং কোথায় যেতে হবে তা নির্ধারিত থাকবে।

২. ভবন নির্মাণে ভূমিকম্প প্রতিরোধী প্রযুক্তি ব্যবহার করুন: নতুন ভবন নির্মাণে বা পুরাতন ভবন সংস্কারে ভূমিকম্প প্রতিরোধী প্রযুক্তি ব্যবহার করুন।

৩. জরুরি সরঞ্জাম সংগ্রহ করুন: একটি জরুরি ব্যাগ প্রস্তুত রাখুন যাতে প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী, পানি, খাবার, টর্চ লাইট, ব্যাটারি, রেডিও ইত্যাদি থাকে।

ভূমিকম্পের সময়:

১. “ড্রপ, কভার এবং হোল্ড” পদ্ধতি অনুসরণ করুন:

  • ড্রপ: হাঁটু গেড়ে বসুন
  • কভার: মাথা এবং ঘাড় রক্ষা করুন
  • হোল্ড: কম্পন শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান বজায় রাখুন

২. যদি ঘরের ভিতরে থাকেন: মজবুত টেবিল বা ডেস্কের নীচে আশ্রয় নিন। জানালা, বাইরের দেয়াল এবং ভারী আসবাবপত্র থেকে দূরে থাকুন।

৩. যদি বাইরে থাকেন: খোলা জায়গায় যান এবং ভবন, গাছ বা বিদ্যুতের তার থেকে দূরে থাকুন।

ভূমিকম্পের পরে:

১. সতর্ক থাকুন: আফটারশক বা পরবর্তী কম্পন হতে পারে।

২. ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে দূরে থাকুন: ক্ষতিগ্রস্ত ভবন এবং অবকাঠামো থেকে দূরে থাকুন।

৩. সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করুন: যদি কেউ আহত হয়, তাহলে জরুরি সেবার সাথে যোগাযোগ করুন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভূমিকম্প

বাংলাদেশ ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। হিমালয় পর্বতমালার কাছাকাছি অবস্থান এবং ভারতীয় ও বার্মিজ টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থলে থাকার কারণে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেট সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ শহর।

বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্প হয়েছে:

  • ১৯৯৭ সালের সিলেট ভূমিকম্প
  • ২০১১ সালের ভারত-নেপাল সীমান্ত ভূমিকম্প, যা বাংলাদেশেও অনুভূত হয়েছিল
  • ২০১৫ সালের নেপাল ভূমিকম্প, যার প্রভাব বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে পড়েছিল

 

ভূমিকম্প কি এবং এর প্রভাব সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত যারা ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলে বাস করেন তাদের জন্য। ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও, সঠিক প্রস্তুতি এবং সচেতনতা দ্বারা এর প্রভাব কমানো সম্ভব। ভূমিকম্পের আগে, সময়ে এবং পরে কী করতে হবে তা জানা জীবন রক্ষা করতে পারে।

পরিশেষে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সামাজিক সচেতনতা এবং সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি। আসুন আমরা সবাই এই বিষয়ে সচেতন হই এবং যথাযথ প্রস্তুতি নিই।

 

Join The Discussion

Compare listings

Compare
Open chat
Hello 👋
Can we help you?