সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে ভূমিকম্প হওয়ার প্রধান কারণ নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প অনুভূত হওয়া প্রমাণ করে যে বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ভূমিকম্পগুলো হালকা হলেও, এটি একটি সংকেত যে আমাদের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থানে নিরন্তর পরিবর্তন হচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন আসে, আসলে কেন বাংলাদেশে ভূমিকম্প হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের দেশের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থান, টেকটনিক প্লেট এবং ফল্ট লাইনগুলো সম্পর্কে জানতে হবে।
বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থান
বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থান ভূমিকম্পের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশ এমন একটি জায়গায় অবস্থিত যেখানে দুটি প্রধান টেকটনিক প্লেট পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়া করছে:
- ইন্ডিয়ান প্লেট – উত্তর-পূর্ব দিকে সঞ্চালন করছে
- বার্মা প্লেট – পশ্চিম দিকে সঞ্চালন করছে
এই দুটি প্লেটের পরস্পরমুখী গতিপথের কারণে সংঘর্ষ হচ্ছে, যা ভূমিকম্পের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। জিপিএস ডেটা অনুযায়ী, এই অঞ্চলে প্লেটগুলির মধ্যে প্রতি বছর 13-17 মিলিমিটার হারে সংকোচন ঘটছে, যার সাথে পার্শ্বীয় গতিও যুক্ত রয়েছে।
হিমালয় পর্বতমালার কাছাকাছি অবস্থানও বাংলাদেশকে ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। হিমালয় নিজেই ইন্ডিয়ান প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি, এবং এই প্রক্রিয়া এখনও চলমান রয়েছে।
প্রধান ফল্ট লাইন ও ভূমিকম্প উৎস
দাউকি ফল্ট: বাংলাদেশের ভূমিকম্পের প্রধান উৎস
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত দাউকি ফল্ট (Dauki Fault) ভূমিকম্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এই ফল্টটি শিলং মালভূমির দক্ষিণ প্রান্ত বরাবর অবস্থিত এবং পূর্ব-পশ্চিম দিকে বিস্তৃত একটি রিভার্স ফল্ট যা উত্তর দিকে ঢাল যুক্ত। গবেষণায় দেখা গেছে, 16 শতাব্দীতে এই ফল্ট লাইনে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল।
দাউকি ফল্টকে “লেট কোয়াটারনারি” সময়ে সক্রিয় ফল্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যার প্রমাণ পাওয়া যায় শিলং মালভূমির ভূ-আকৃতিগত বৈশিষ্ট্য, গ্র্যাভিটি অ্যানোমালি ডেটা এবং শিলং মালভূমির দক্ষিণ পাদদেশে উত্তোলিত তৃতীয়ক ও চতুর্থক জমাট থেকে।
সিলেট-চট্টগ্রাম এলাকার বিশেষ ভূমিকা
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার প্রধান উৎস হচ্ছে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা। এই অঞ্চলটি দুটি প্লেটের সংযোগস্থল হিসেবে কাজ করে, এবং প্লেট সীমানা বরাবর ফল্ট বা ভ্রংশ রেখা তৈরি হয়েছে। বিশেষত সিলেট এলাকায় যেসব ভূমিকম্প হচ্ছে সেগুলোর অধিকাংশই কম গভীরতায় সংঘটিত হচ্ছে, যা এই অঞ্চলের ভূ-তাত্ত্বিক জটিলতার প্রমাণ বহন করে।
সাম্প্রতিক ভূমিকম্প ও তাদের বৈশিষ্ট্য
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে:
- 14ই অগাস্ট, 2024 – রাত 8টা 49 মিনিটে রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ এলাকায় 5.5 মাত্রার ভূমিকম্প। উৎপত্তিস্থল: সিলেটের কানাইঘাট, গভীরতা: 10 কিলোমিটার।
- 16ই জুন, 2024 – রাজধানীসহ সারা দেশে 4.5 মাত্রার মৃদু ভূমিকম্প, উৎপত্তিস্থল: সিলেটের গোলাপগঞ্জ।
- 5ই মে, 2024 – ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকায় 4.3 মাত্রার ভূমিকম্প। উৎপত্তিস্থল: ঢাকার কাছে বিক্রমপুরের দোহার থেকে প্রায় 14 কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে, গভীরতা: 10 কিলোমিটার।
উপরোক্ত তিনটি ভূমিকম্পের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো তাদের কম গভীরতা (10 কিলোমিটার)। কম গভীরতার ভূমিকম্প পৃথিবীপৃষ্ঠে অধিক তীব্রতা সহকারে অনুভূত হয় এবং প্রায়শই বেশি ক্ষতি সাধন করে।
ভূমিকম্পের সাধারণ কারণ ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
টেকটনিক প্লেট সঞ্চালন: মূল কারণ
পৃথিবীর উপরিভাগ বিভিন্ন টেকটনিক প্লেট দিয়ে গঠিত, যেগুলো ধীরে ধীরে চলাচল করে। যখন এই প্লেটগুলো একে অপরের সাথে ঘর্ষণে আসে বা ধাক্কা খায়, তখন প্রচুর পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হয়। এই শক্তি যখন হঠাৎ মুক্তি পায়, তখন ভূমিকম্প সংঘটিত হয়।
বাংলাদেশের ভূমিকম্পগুলো মূলত শক্তি বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়া। দুটি প্লেটের মধ্যে সঞ্চিত শক্তি বেরিয়ে আসছে এবং সেটাই জানান দিচ্ছে এই ছোট ভূমিকম্পগুলো।
ফল্ট লাইনের সক্রিয়তা
দাউকি ফল্টসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ফল্ট লাইনে ঘটতে থাকা সক্রিয়তা ভূমিকম্পের অন্যতম কারণ। ট্রেঞ্চ অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে যে দাউকি ফল্টে 16 শতাব্দীতে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছিল, এবং এটি এখনও সক্রিয় রয়েছে। এই ফল্ট লাইন এবং অন্যান্য ফল্ট লাইনে শক্তি সঞ্চয় হয় এবং তা পরবর্তীতে ভূমিকম্প আকারে মুক্তি পায়।
ভবিষ্যতে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা ও প্রস্তুতি
বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান ও ইতিহাস বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে ভবিষ্যতে দেশে মাঝারি থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটতে থাকা ছোট ছোট ভূমিকম্প এই সম্ভাবনাকে আরও জোরদার করে।
সম্প্রতি সিলেট ও চট্টগ্রাম এলাকায় ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পগুলো বিশেষভাবে উদ্বেগের কারণ, কারণ এগুলো কম গভীরতায় সংঘটিত হচ্ছে এবং দাউকি ফল্টের মতো সক্রিয় ফল্ট লাইনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই অঞ্চলে ভবিষ্যতে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি
ভবিষ্যতে সম্ভাব্য ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে:
- ভূমিকম্প-প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ
- ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রশিক্ষণ
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি
- পরিকল্পিত নগরায়ন
বিশেষত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট শহরে অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ভূমিকম্পজনিত ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশে ভূমিকম্প হওয়ার প্রধান কারণ হলো দেশের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থান, যেখানে ইন্ডিয়ান ও বার্মা প্লেটের সংঘর্ষ হচ্ছে। দাউকি ফল্টসহ বিভিন্ন ফল্ট লাইন, সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত প্লেট সীমানা এবং ইন্ডিয়ান প্লেটের উত্তর-পূর্ব দিকে সঞ্চালন ভূমিকম্পের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলোর বিশ্লেষণে দেখা যায় যে এগুলো মূলত কম গভীরতায় সংঘটিত হচ্ছে, যা এদের ক্ষতিকারক প্রভাব বাড়িয়ে দিতে পারে।
ভবিষ্যতে বড় মাত্রার ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশকে আরও প্রস্তুত হতে হবে। ভূমিকম্প অবশ্যম্ভাবী, কারণ টেকটনিক প্লেটগুলো সঞ্চালন অব্যাহত রাখবে এবং শক্তি বেরিয়ে আসবেই। গুরুত্বপূর্ণ হল এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা, যাতে ভূমিকম্পজনিত ক্ষয়ক্ষতি যথাসম্ভব কমানো যায়।