বাংলাদেশের ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা নিয়ে আজ আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিকভাবে দুটি গতিশীল ভূ-গাঠনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় দেশটি ভূমিকম্প প্রবণ দেশগুলির মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বড় আকারের ভূমিকম্প হয়নি, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে এই অঞ্চলে প্লেটগুলি পরস্পরের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছে, যা ভবিষ্যতে শক্তিশালী ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (BNBC) দেশকে ভূমিকম্প ঝুঁকির ভিত্তিতে কয়েকটি জোনে বিভক্ত করেছে, যেখানে উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত। এই নিবন্ধে আমরা বাংলাদেশের ভূমিকম্প প্রবণ এলাকাগুলির বিস্তারিত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করব।
জোন | ঝুঁকির মাত্রা | ভূমিকম্পের তীব্রতা | অঞ্চলসমূহ |
---|---|---|---|
জোন ৩ / ৪ | সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ | 0.25g পর্যন্ত | সিলেট বিভাগ: সিলেট, মৌলভীবাজার, জৈন্তাপুর পার্বত্য চট্টগ্রাম: রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি (উত্তরাংশ) কক্সবাজার: দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল |
জোন ২ | মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ | 0.15g পর্যন্ত | ঢাকা বিভাগ: ঢাকা, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ চট্টগ্রাম বিভাগ: চট্টগ্রাম শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা কুমিল্লা বিভাগ: ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ময়মনসিংহ বিভাগ: ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর, জামালপুর রংপুর বিভাগ: রংপুর (আংশিক) অন্যান্য: মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ |
জোন ১ | সর্বনিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ | 0.075g পর্যন্ত | দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল: খুলনা ও বরিশাল বিভাগের প্রায় পুরো এলাকা |
বাংলাদেশের সিসমিক জোনিং
বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (BNBC) দেশকে ভূমিকম্পের ঝুঁকির ভিত্তিতে কয়েকটি জোনে বিভক্ত করেছে। এই জোনিং সিস্টেম ভবন নির্মাণে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং ভূমিকম্পের প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
BNBC অনুসারে সিসমিক জোন বিভাজন
BNBC-এর সর্বশেষ সংস্করণ অনুসারে বাংলাদেশকে ভূমিকম্পের ঝুঁকির উপর ভিত্তি করে চারটি সিসমিক জোনে বিভক্ত করা হয়েছে, যেখানে জোন ৪ সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। অন্যদিকে, BNBC 1993 অনুসারে তিনটি সিসমিক জোনের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে:
- জোন ৩ = 0.25g (সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ)
- জোন ২ = 0.15g (মধ্যম ঝুঁকিপূর্ণ)
- জোন ১ = 0.075g (সর্বনিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ)
এখানে ‘g’ হলো মাধ্যাকর্ষণ ত্বরণ, যা ভূমিকম্পের তীব্রতা পরিমাপের একটি মান।
সিসমিক জোনিং ম্যাপ নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে:
- সম্ভাব্য ভূমি কম্পনের অনুমান
- ভূমিকম্পের কেন্দ্র (এপিসেন্টার), মাত্রা এবং গভীরতা নির্ধারণ
- ভূমিকম্পে কাঠামোর আচরণ সম্পর্কে ধারণা প্রদান
বাংলাদেশের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসমূহ
সিসমিক জোনিং ম্যাপ অনুসারে, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে সিলেট বিভাগ এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে চট্টগ্রাম বিভাগ, সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। এছাড়া, ঢাকা এবং এর আশপাশের এলাকাগুলিও মাঝারি থেকে উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী এলাকাসমূহ, বিশেষ করে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অধিকাংশ এলাকা, তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ।
ভূমিকম্প ঝুঁকির কারণ ও ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকির পিছনে বেশ কিছু ভূতাত্ত্বিক কারণ রয়েছে। দেশটির ভূগর্ভীয় অবস্থান এবং নিকটবর্তী টেকটনিক প্লেটসমূহের সক্রিয়তা এই ঝুঁকির প্রধান উৎস।
টেকটনিক প্লেট ও সক্রিয় ফল্ট লাইন
বাংলাদেশ দুটি প্রধান টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থলের নিকটে অবস্থিত। গবেষক ও ভূতত্ত্ববিদ মাইকেল স্টেকলার টমসনের মতে, এই গতিশীল ভূ-গাঠনিক প্লেটগুলি পরস্পরের ওপর চেপে বসতে থাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি ক্রমাগত জমা হচ্ছে। যদিও এখনই বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, তবে এই অঞ্চলে ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্প হওয়ার প্রবণতা যথেষ্ট।
সিলেট অঞ্চলের উচ্চ ঝুঁকির কারণ হল দাউকি ফল্ট এবং তার নিকটবর্তী ভূমি ভ্রংশগুলি। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম এবং এর আশপাশের এলাকাগুলি ভারতীয় প্লেট এবং বার্মিজ মাইক্রোপ্লেটের সংঘর্ষের কারণে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ।
ভূমিকম্প ঝুঁকি মূল্যায়ন পদ্ধতি
বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ডুগলের (1989) অ্যাটেনুয়েশন ল ব্যবহার করে সিসমিক হ্যাজার্ড ম্যাপিং উল্লেখযোগ্য। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন সময়কাল (রিটার্ন পিরিয়ড) যেমন 200 বছর এবং 475 বছরের জন্য ঝুঁকি মূল্যায়ন করা হয়। 50 বছরে 22% এবং 10% প্রবাবিলিটি অব এক্সিডেন্স (probability of exceedance) ধরে এই ম্যাপগুলি তৈরি করা হয়েছে।
সিসমিক জোন অনুসারে এলাকা বিভাজন
বাংলাদেশের সিসমিক জোনিং ম্যাপ বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলকে ভূমিকম্পের ঝুঁকির ভিত্তিতে বিভক্ত করেছে। এই বিভাজন দেশের বিভিন্ন অংশে ভূমিকম্প-প্রতিরোধী কাঠামো নির্মাণের দিকনির্দেশনা দেয়।
জোন ভিত্তিক ভূমিকম্প প্রবণতা
জোন ৩/৪ (সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা)
- সিলেট বিভাগ: সিলেট, মৌলভীবাজার, জৈন্তাপুর (বিশেষভাবে জৈন্তাপুর এলাকা)
- পার্বত্য চট্টগ্রাম: রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি (বিশেষত উত্তরাংশ)
- কক্সবাজার (দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল)
এই অঞ্চলে ভূমিকম্পের তীব্রতা 0.25g পর্যন্ত হতে পারে।
জোন ২ (মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা)
- ঢাকা বিভাগ: ঢাকা শহর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ (কিছু অংশ)
- চট্টগ্রাম বিভাগ: চট্টগ্রাম শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা
- কুমিল্লা বিভাগ: ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা (কিছু অংশ)
- ময়মনসিংহ বিভাগ: ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর, জামালপুর
- রংপুর বিভাগ: রংপুর (কিছু অংশ)
- অন্যান্য: মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ (কিছু অংশ)
এই অঞ্চলে ভূমিকম্পের তীব্রতা 0.15g পর্যন্ত হতে পারে।
জোন ১ (সর্বনিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা)
- দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল: খুলনা ও বরিশাল বিভাগের প্রায় পুরো এলাকা
এই অঞ্চলে ভূমিকম্পের তীব্রতা 0.075g পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে।
ভবন নির্মাণ কোড এবং প্রয়োগ
BNBC-এর সিসমিক জোনিং এর প্রধান উদ্দেশ্য ভবন নির্মাণে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যে অঞ্চলগুলি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ (যেমন জোন ৩ বা ৪), সেখানে ভবন নির্মাণে অধিক কঠোর কোড অনুসরণ করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে:
- উন্নত ভূমিকম্প-প্রতিরোধী ডিজাইন
- মজবুত ভিত্তি
- নির্মাণ সামগ্রীর উচ্চতর মান
- বিদ্যমান ভবনগুলির রেট্রোফিটিং
ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা
বাংলাদেশে ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এই পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস এবং এর প্রভাব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে।
সিসমিক স্টেশন ও মনিটরিং সিস্টেম
বাংলাদেশে এবং এর আশপাশে বেশ কিছু সিসমিক স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। এই স্টেশনগুলি দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্পের কম্পন পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (BMD), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (BUET) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে এই পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলি পরিচালনা করে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
- জামুনা বহুমুখী সেতুতে ত্রিমাত্রিক অ্যাকসেলারোমিটার সেন্সর ব্যবহার করা হয়, যা তিনটি দিকে ত্বরণ পরিমাপ করে
- উন্মুক্ত ক্ষেত্রে (ফ্রি ফিল্ড স্টেশন) বিভিন্ন স্থানে যেমন ময়মনসিংহ, গাজীপুর, বগুড়া, নাটোরে পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে
ডাটা ট্রান্সমিশন ও প্রসেসিং
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সিসমিক ডাটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়। স্প্রেড স্পেকট্রাম/GPS প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডাটা ট্রান্সমিশন এবং একটি ডাটা কন্ট্রোল সেন্টারে নিরবিচ্ছিন্ন ডাটা স্ট্রিমিং করা হয়। যে সকল ভূমিকম্প নির্দিষ্ট থ্রেশহোল্ড অতিক্রম করে, সেগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড করা হয়। এই তথ্য ব্যবহার করে ভূমিকম্পের প্যাটার্ন বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যৎ ঝুঁকি মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়।
ভূমিকম্প প্রতিরোধ ও প্রস্তুতি
বাংলাদেশের মতো ভূমিকম্প প্রবণ দেশে সঠিক প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে:
ভূমিকম্প-প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ
সিসমিক জোন অনুযায়ী ভবন নির্মাণে BNBC-এর নিয়ম মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে উচ্চ ঝুঁকি সম্পন্ন এলাকায় ভূমিকম্প-প্রতিরোধী ডিজাইন অনুসরণ করা উচিত। এর মধ্যে রয়েছে:
- সঠিক ভিত্তি নির্মাণ
- শক্তিশালী কলাম ও বিম ব্যবহার
- নমনীয় যোগসূত্র ব্যবহার
- হালকা নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার
জনসচেতনতা বৃদ্ধি
ভূমিকম্প সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং ভূমিকম্প কালীন করণীয় সম্পর্কে জনগণকে শিক্ষিত করা প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে:
- ভূমিকম্প ড্রিল প্রশিক্ষণ
- আশ্রয় নেওয়ার পদ্ধতি
- প্রাথমিক চিকিৎসা প্রশিক্ষণ
- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জ্ঞান
বাংলাদেশ একটি ভূমিকম্প প্রবণ দেশ হিসেবে বিবেচিত, বিশেষত এর উত্তর-পূর্বাঞ্চল (সিলেট অঞ্চল) এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল (চট্টগ্রাম অঞ্চল)। বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (BNBC) দেশকে তিন থেকে চারটি সিসমিক জোনে বিভক্ত করেছে, যেখানে জোন ৩ (বা ৪) সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং জোন ১ সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশের ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য যথাযথ ভবন নির্মাণ কোড অনুসরণ, ভূমিকম্প সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ অপরিহার্য। বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন সিসমিক স্টেশন স্থাপন ও ডাটা সংগ্রহের মাধ্যমে ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও উন্নত পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং ভূমিকম্প-প্রতিরোধী নির্মাণ কৌশল অবলম্বন করে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমানো সম্ভব