বাংলাদেশে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে আইন ও প্রথা দুইটিরই গভীর প্রভাব রয়েছে। একটি নিঃসন্তান ব্যক্তি মারা গেলে তার সম্পত্তি কীভাবে বণ্টিত হবে, তা দেশের প্রচলিত আইনের উপর নির্ভরশীল। ধর্মীয় আইনের অধীন সম্পত্তির বণ্টন যেমন ইসলামি উত্তরাধিকার আইন (ফরজ) এবং পারিবারিক সম্পর্কের ধরন এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এখানে আলোচনা করা হবে নিঃসন্তান ব্যক্তির সম্পত্তির বণ্টনের বিভিন্ন দিক, বাংলাদেশি আইনের আওতায়।
১. বাংলাদেশি আইন অনুযায়ী সম্পত্তির বণ্টন
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, যদি কোন ব্যক্তি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান এবং পূর্বে কোন উইল (ইচ্ছাপত্র) না করেন, তবে তার সম্পত্তি বণ্টিত হবে ইন্টেস্টেসি (Intestacy) আইনের অধীনে। ইন্টেস্টেসি আইন অনুসারে, ব্যক্তির ধর্ম ও সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির উপর নির্ভর করে সম্পত্তির বণ্টন হয়।
মুসলিম উত্তরাধিকার আইন:
বাংলাদেশে মুসলিমদের জন্য সম্পত্তির বণ্টন ফরজ আইন দ্বারা নির্ধারিত হয়, যা ইসলামের শিক্ষার উপর ভিত্তি করে তৈরি। একটি নিঃসন্তান মুসলিম ব্যক্তির ক্ষেত্রে সম্পত্তি তার স্ত্রী/স্বামী, ভাইবোন, এবং অন্যান্য নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বণ্টিত হয়।
- স্বামী/স্ত্রী: নিঃসন্তান মুসলিম পুরুষের ক্ষেত্রে, তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীর প্রাপ্য হয় ১/৪ ভাগ। আর একটি নারী মারা গেলে, তার স্বামী পাবে সম্পত্তির ১/২ ভাগ।
নিকটাত্মীয়দের প্রাপ্যতা: যদি অন্যান্য উত্তরাধিকারী যেমন ভাইবোন, মা-বাবা, এবং অন্যান্য নিকটাত্মীয় থাকে, তাহলে তারা ইসলামি আইন অনুসারে নির্ধারিত হারে সম্পত্তি পাবে।
হিন্দু উত্তরাধিকার আইন:
বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সম্পত্তির বণ্টনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিধান দেয়। হিন্দু ব্যক্তি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে তার সম্পত্তি মূলত তার নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বণ্টিত হয়।
- পিতা-মাতা: যদি ব্যক্তি নিঃসন্তান মারা যায় তবে তার পিতা-মাতা যদি বেঁচে থাকে, তাহলে তারা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন।
- ভাইবোন: ভাইবোন থাকলে, তারা সাধারণত পিতামাতার পরের ক্রমে উত্তরাধিকারী হন।
উইল (ইচ্ছাপত্র) করা:
একটি নিঃসন্তান ব্যক্তি যদি তার জীবদ্দশায় একটি উইল (ইচ্ছাপত্র) করে যান, তবে তার সম্পত্তি উইলে বর্ণিত ব্যক্তিদের মধ্যে বণ্টিত হয়। উইলের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নির্দিষ্টভাবে কার কাছে তার সম্পত্তি যাবে তা নির্ধারণ করতে পারেন। তবে, উইল করার ক্ষেত্রে ইসলামী আইনে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
আরও পড়ুন
২. উইল না করা হলে কি ঘটে?
যদি কোনো ব্যক্তি উইল না করেন এবং তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান, তবে তার সম্পত্তি ইন্টেস্টেসি আইনের আওতায় বণ্টিত হবে। এই আইন বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে পৃথকভাবে প্রযোজ্য। অর্থাৎ, ব্যক্তির ধর্ম অনুসারে তার সম্পত্তি বণ্টিত হবে।
৩. সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশে সামাজিকভাবে সম্পত্তির বণ্টনের ক্ষেত্রে পারিবারিক সম্পর্ক এবং আত্মীয়তার গুরুত্ব অনেক বেশি। নিঃসন্তান ব্যক্তির সম্পত্তির বণ্টনের সময় পরিবারের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইসলামি সমাজে, সম্পত্তির বণ্টন সম্পর্কিত ফরজ আইন অত্যন্ত সম্মানিত, এবং পারিবারিক ঐক্য বজায় রাখতে এটি প্রধান ভূমিকা পালন করে। হিন্দু সম্প্রদায়েও পারিবারিক সম্পদের উত্তরাধিকারী নির্ধারণে প্রথাগত নিয়মগুলো সম্মানিত হয়।
৪. আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা
বর্তমানের কিছু আইনি ব্যবস্থা নিঃসন্তান ব্যক্তির সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করতে পারে, যেমন পারিবারিক বিবাদ, সম্পত্তি নিয়ে আদালতে মামলা ইত্যাদি। অনেকেই মনে করেন, উইল এবং ইন্টেস্টেসি আইনের আরও আধুনিক ও সমন্বিত সংস্কার করা প্রয়োজন যাতে সম্পত্তির বণ্টন প্রক্রিয়া আরো সহজ ও শান্তিপূর্ণভাবে করা যায়।
৫. সম্পত্তির বণ্টন নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন
নিঃসন্তান ব্যক্তিদের সম্পত্তির বণ্টনের ক্ষেত্রে উইল করার সচেতনতা অনেক কম। অনেকেই উইল তৈরি করেন না, যার ফলে মৃত্যুর পর তাদের সম্পত্তি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। তাই সম্পত্তির বণ্টন নিয়ে উইল তৈরি করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। উইল তৈরি করা ব্যক্তির অধিকার এবং সম্পত্তি সংক্রান্ত বিবাদ কমিয়ে দিতে পারে।
উপসংহার
নিঃসন্তান ব্যক্তির সম্পত্তির বণ্টনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনি ও ধর্মীয় বিধানগুলো মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। একটি উইল তৈরি করা নিঃসন্দেহে একটি উপযুক্ত উপায় যাতে ব্যক্তি তার সম্পত্তির সঠিক বণ্টন নিশ্চিত করতে পারেন। এর সাথে সাথে সামাজিক ও পারিবারিক স্তরে সম্পত্তির বণ্টনের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া উচিত।
রেফারেন্স:
- বাংলাদেশ মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১।
- হিন্দু উত্তরাধিকার আইন, ১৯৫৬।
- Hasan, M. (2020). Legal aspects of inheritance in Bangladesh. Dhaka Law Journal.
- Hossain, A. (2019). The importance of wills in Bangladesh: Legal and social perspectives. Bangladesh Legal Forum.